মণ্ডপে মণ্ডপে কেবল চিন্ময়ী মায়ের রূপ, ব্রাত্য রক্ত মাংসে গড়া উমা'রা - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Tuesday 27 September 2022

মণ্ডপে মণ্ডপে কেবল চিন্ময়ী মায়ের রূপ, ব্রাত্য রক্ত মাংসে গড়া উমা'রা


আশ্বিন মাস পড়লেই শরতের তুলোর মতো মেঘ আর কাশফুলের সমারোহ দেখলেই বাঙালির মনের ভিতরটা আনন্দে ভরে ওঠে। কারণ এবারে 'দেবী উমার মর্ত্যে আগমণের পালা। তাঁর আরাধনাতে মেতে ওঠে আপামর বাঙালি সমাজ। দেবী উমার 'মৃন্ময়ী রূপ'-এর আরাধনার মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালি প্রত্যক্ষ করতে চায় মায়ের 'চিন্ময়ী রূপ' কে। 


দেবীকে মাতৃজ্ঞানে আরাধনা করে ধন্য হয়ে ওঠেন সকলে। যদিও একইভাবে এই আশ্বিনের দেবী আরাধনার মধ্যেই ব্রাত্য হয়ে থাকে অনেক রক্ত মাংসের দেবী, যাদের জীবন সংসার প্রতিপালনের মাধ্যমে মায়ের স্নেহে, মমতায়, যত্নে তিল তিল করে মানুষ করতে চেষ্টা করেছে তাদের সন্তানদের। তবু উচ্চ শিক্ষিত হয়ে তাঁরাই বিসর্জন দিয়েছে এই রক্ত মাংসের দেবী উমাদের। অথচ, আশ্বিনে দেবীর মৃন্ময়ী রূপের আরাধনাতে সেই সন্তানেরাও ব্রতী হয়েছেন। 


কিন্তু সন্তান বিসর্জন দিলেও মায়ের মনের টান আজও প্রখরভাবেই বিদ্যমান। তাই কথায় কথায় আজও চোখের কোণে চলে আসে জল। ঠোঁটে অভিমানের শব্দ এলেও মনের ভেতরটা একেবারেই শূন্য। তবু এই শূন্যতার মধ্যে জীবনের অনেক অপূর্ণতাকে নিয়েই জীবনের শেষের দিনগুলো কাটছে 'আনন্দম' বৃদ্ধাবাসে। এখানকার আবাসিকরাই এখন সকলে সকলের একান্ত আপন, আস্ত এক পরিবার। তাই সচেতনভাবেই নিজেদের পরিবার সন্তান সন্ততিকে ভুলেই হাতে পাওয়া চোদ্দ আনা দিয়েই দুধের স্বাদ মেটাচ্ছেন ঘোলে। 


বৃদ্ধাশ্রমের কর্মী অর্চনা চক্রবর্তী জানান, এটাই এখন তাঁদের সংসার। এই বৃদ্ধ মানুষদের নিয়ে তাঁদের সারাদিন কীভাবে কেটে যায়, তাঁরা বুঝতেও পারেন না। এরাই এখন তাঁদের আত্মীয়, বাবা-মা সব। তিনি আরও বলেন, 'এখানে ৪২ জন বয়স্কা মহিলারা আছেন, তাঁদের এখানে দিয়ে যাওয়ার পরে তাঁদের ৭০% পরিবারের লোক আর তাঁদের খোঁজ রাখেন না।'


এই বৃদ্ধাশ্রমের পরপথম আবাসিক কণিকা দাস জানান, তিনি এখানে যখন এসেছিলেন তখন একটা টালির চালের কুঁড়ে ঘর ছিল। এখন বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে। ছেলে-বৌয়ের অত্যাচারে তিনি এখানে আসতে বাধ্য হয়েছেন। শুরুতে নিজেই রেঁধে খেতেন। তাতে খুব শান্তি ছিল। এখনও মনে পরে তার বাপের বাড়ির দুর্গা পুজোর কথা। পুজো এলেই বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়ির পুজোয় মেতে ওঠার কথা। তবে স্বামীর থেকে যে প্রেম ভালোবাসা যত্ন পেয়েছেন তা কখনও কারও থেকে পান নি আর। তাই একাকিত্ব লাগলেই স্বামীর কথা মনে পড়ে, আর তখন বই পড়ার নেশাতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন। 


ছেলের সঙ্গে নারীর টান আজও ভুলতে পারেন নি বছর আশির কণিকা। তাই ছেলে যদি মা বলে ডাকতো সেটা শুনতে খুব মধুর লাগতো বলেই চোখের কোনটা চিকচিক করে ওঠে অভিমানী জলে। তবে এখানে এসে খুবই শান্তিতে আছেন বলেই জানান তিনি।


শুধু পরিবারের সদস্যদের থেকে লাঞ্চিত হয়ে এখানে আসা তা ঠিক নয় বলে জানান নয় মাস আগে এখানে আসা বছর সত্তরের শিপ্রা চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানান, স্বামী অনেকদিন আগেই মারা যান। নয় মাস আগে তার একমাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সী মেয়ের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে একা ফ্ল্যাটে থাকতে একাকিত্ব গ্রাস করেছিল তাঁকে। তাই এখানে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তবে এখানে এসে থাকতে পারবেন কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহ নিয়েই এসেছিলেন। কিন্তু আজকে এখন থেকে আর ফেরত যেতে মন চায় না। এখানের অন্যান্য আবাসিকদের সঙ্গে আত্মীয়তা, সাহচর্যে তিনি একাকিত্বকে পাশ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলেই দাবী করেন শিপ্রা দেবী। এখানে তিনি অনেক ভালো আছেন বলেই জানান।


বৃদ্ধাশ্রমের জীবনে ছোট বড়ো বয়সী আবাসিকদের নিয়ে তৈরী হওয়া শেষ জীবনের স্মৃতি নিয়েই জীবন্ত উমা'রা জীবনের চরম সত্যির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। তবে সমাজের নিয়মে কোথাও যে মানবিকতার ফাটল দেখতে পাওয়া যায়, এই রক্তমাংসের উমাদের দেখে তা যেন আমাদের তৈরি সভ্যতার দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, আজও আমরা দেবী মায়ের মৃন্ময়ী রূপ থেকে উত্তরণ করতে পারলাম না, মায়ের চিন্ময়ী রূপ দর্শন করতে। যারা সন্তানদের জন্ম দিয়ে তাঁদের প্রতিপালনের মাধ্যমে সমাজে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন, সেই উমাকে ভুলে গেলে দেবী উমাও অধরা হয়ে থাকবে এই সমাজের বুকে।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad