৩৫০ বছরেরও প্রাচীন! ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে পাহাড়পুর দুর্গা-দালান, হেরিটেজ তকমার দাবী - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Monday, 15 May 2023

৩৫০ বছরেরও প্রাচীন! ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে পাহাড়পুর দুর্গা-দালান, হেরিটেজ তকমার দাবী


৩৫০ বছরেরও প্রাচীন! ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে পাহাড়পুর দুর্গা-দালান, হেরিটেজ তকমার দাবী 




নিজস্ব সংবাদদাতা, মালদা, ১৫ মে: সেদিনের সেই নদী আর নেই। কিন্তু সেই নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত মন্দির থেকে গেছে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে চাঁচল ১ নম্বর  ব্লকের পাহাড়পুরের চণ্ডী মণ্ডপ। রাজ আমলে প্রতিষ্ঠিত। প্রায় ৩৫০ বছরেরও বেশি প্রাচীন এই মন্দির,  যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ইতিহাস। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রচলিত রয়েছে বহু গল্প। তবে কালের নিয়মে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সেই ইতিহাস। এই মন্দিরকেই হেরিটেজ তকমা দেওয়ার দাবী তুলেছেন চাঁচলবাসী।


সময়টা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ। সেইসময় উত্তর মালদার বিস্তীর্ণ এলাকার রাজা ছিলেন রামচন্দ্র রায়চৌধুরী। শুধু বাংলা নয়, বিহারের কিছু অংশও তাঁর রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হলেও প্রজাদরদি এবং ধর্মপ্রাণ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব ভারতজুড়ে। ঘরে বসে নয়, হাতির পিঠে চেপে তিনি নিয়মিত বেরিয়ে পড়তেন নিজের রাজত্ব দেখাশোনা করতে। গঙ্গা-মহানন্দার দুই পাড়ে উর্বরা জমির চাষ পরিদর্শন, প্রজাদের সুখ-দুঃখের খবরাখবর নেওয়া ছিল তাঁর রোজনামচা। 


কথিত আছে, একবার তিনি যখন এভাবেই রাজত্ব দেখতে বেরিয়ে বাইরে রাত কাটাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন দেবী চণ্ডী। রাজাকে তিনি আদেশ দিয়েছিলেন, মহানন্দার সতীঘাটায় তাঁর চতুর্ভুজা অষ্টধাতু নির্মিত মূর্তি রয়েছে। রাজাকে সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুরু করতে হবে দুর্গা পুজো। দেবীর আদেশ পেয়ে পরদিন সকালেই সতীঘাটায় চলে যান রাজা। স্বপ্নাদেশে বর্ণিত জায়গায় নদীতে নেমে তুলে আনেন দেবী চণ্ডীর মূর্তি। সেবার থেকেই শুরু হয় রাজবাড়ির দুর্গা পুজো। 


দেবী চণ্ডীর অষ্টধাতুর মূর্তি সতীঘাটা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে রাজবাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করেন রাজা রামচন্দ্র। সেদিন থেকেই রাজবাড়িতে শুরু হয় দেবীর নিত্য পুজো। পরবর্তীতে ফের দেবীর স্বপ্নাদেশ পান রাজা৷ আদেশ অনুযায়ী সতীঘাটায় দেবীর আরেকটি মন্দির নির্মাণ করেন তিনি।


তবে প্রথমে সেখানে মাটির ঘর ও খড়ের ছাউনি দিয়েই মন্দির তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে রাজবংশের অন্যতম রাজা শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরীর নির্দেশে তৎকালীন ম্যানেজার সতীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে সেখানে পাকা দুর্গাদালান নির্মিত হয়। ততদিনে জায়গাটির নাম পরিবর্তিত হয়ে পাহাড়পুর হয়েছে। এখনও সেখানে রয়েছে সেই দুর্গাদালান। যেটি পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপ নামে পরিচিত। প্রতি বছর এখানেই রাজবাড়ির দুর্গা পুজো অনুষ্ঠিত হয়। 


প্রাচীন প্রথা মেনে এখনও সপ্তমী তিথিতে রাজবাড়ি থেকে দুর্গাদালানে নিয়ে আসা হয় অষ্টধাতুর চতুর্ভুজা মা চণ্ডীকে। দশমী তিথিতে তিনি ফের রাজবাড়িতে ফিরে যান। কথিত আছে, ওই জায়গায় মহানন্দার তীরে এই রাজ পরিবারের একজন সতী হয়েছিলেন। তখন থেকেই জায়গাটি সতীঘাটা নামে পরিচিত। রামচন্দ্র রায়চৌধুরীর পর ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী, শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরি এখানে রাজত্ব করেন। পরবর্তীতে শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরীর রাজত্ব ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়। 


কলকাতা হাইকোর্টের আদেশে শরৎচন্দ্রের রাজত্বের অংশ আসে রাজ্য সরকারের অফিসিয়াল ট্রাস্টির মালিকানায়। এই ট্রাস্টি বোর্ডের একটি লোকাল ম্যানেজিং কমিটিও রয়েছে। এই কমিটি রাজত্বের আয় ব্যয়ের হিসেব সরকারকে পাঠায়। তার ভিত্তিতে এখানে একটি বাজেট পাঠানো হয়। সেই বাজেট মেনেই এখন রাজ পরিবারের সমস্ত খরচ বহন করা হয়।


এছাড়াও এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ইতিহাস। কথিত আছে, একসময় সতীঘাটার মহানন্দার পশ্চিমপাড়ে মহামারী দেখা দিয়েছিল। তখন দেবী সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন, গোধুলি লগ্নে বিসর্জনের সময় তারা যেন মাকে আলো হাতে পথ দেখায়। তখন থেকেই প্রতি বছর বিসর্জনের সময় সেখানকার মুসলমানরা হাতে লণ্ঠন, মোমবাতি, এখন মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে মাকে পথ দেখায়।


এরপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল; নেই রাজা, রাজ্যপাটও নেই। চাঁচল রাজবাড়িতেই এখন স্থাপিত হয়েছে কলেজ, মহকুমা প্রশাসনিক ভবন, আদালত সহ একাধিক সরকারি দপ্তর। তবে রাজবাড়ির একাংশে থাকা ঠাকুরবাড়ি এখনও আগের মতোই রয়ে গিয়েছে। আর বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়পুরের দুর্গা-দালান।


স্থানীয় বাসিন্দা দীপক চট্টোপাধ্যায় বলেন, "ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচার করে এই দুর্গা-দালানকে সরকার হেরিটেজ তকমা দিলে খুব ভালো হবে। মালদায় শুধু গৌড় বা আদিনা নয় চাঁচলকেও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। সেটা হলে যেমন নতুন প্রজন্ম ইতিহাস জানতে পারবে তেমনই অনেকের কর্মসংস্থান হবে।"


বিশিষ্ট আইনজীবী সুবেশ মিত্র বলেন, "এই দুর্গাদালানের সঙ্গে বহু ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু পরিচর্যার অভাবে সেই ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সরকারের কাছে আবেদন করব, পুজোর জন্য অফিসিয়াল ট্রাস্ট বোর্ডকে যাতে সরকার সাহায্য করে।"

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad