বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই হোটেল কেন চালু হয়নি এখনও? - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Tuesday 25 July 2023

বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই হোটেল কেন চালু হয়নি এখনও?



বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই হোটেল কেন চালু হয়নি এখনও?


প্রেসকার্ড নিউজ ওয়ার্ল্ড ডেস্ক, ২৫ জুলাই: ৩০০০ টি কক্ষসহ রহস্যময় একটি হোটেল যে হোটেলে কখনও একজন অতিথিও ছিল না। উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ং শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, রিউগিং হোটেলটি বিশ্বের বৃহত্তম হোটেল গুলির মধ্যে একটি এর স্থাপত্য ও প্রকৌশলের একটি চিন্তাকর্ষক কীর্তি। যাইহোক ৩০ বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে নির্মাণধীন থাকা সত্ত্বেও, হোটেলটি কখনো অতীতের জন্য খোলেনি, যার ফলে এটি চালু করতে ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে অনেকেই বিস্তৃত হয়। আমরা হোটেল নির্মাণের পেছনে ইতিহাস এবং রাজনীতি পাশাপাশি এর পরিত্যক্ত অবস্থাকে ঘিরে থাকা গুজব এবং তত্তগুলি নিয়ে আলোচনা করব।  


জানেন বিগত ৩০ বছর ধরে খোলা আকাশের নীচে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে এই হোটেলটি। আজ অবধি একজন মানুষও পা রাখেনি এই হোটেলে। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে তৎকালীন হিসেবে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়েছিল এই হোটেল। নির্মাণে সময় লেগেছিল পাক্কা ৬ বছর (১৯৮৭-১৯৯২)। ৩৯ লাখ স্কোয়্যার ফিট জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই রিয়াংগং হোটেল উচ্চতায় প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের থেকে বড়। এই গগনচুম্বী অট্টালিকার সঙ্গে তুলনা করলে আশেপাশের বহুতল বাড়িগুলোকে পিগমির মতো মনে হয়। দুটো দশটা নয় এই হোটেলে পর্যটকদের রাত্রিবাসের জন্য মজুত রয়েছে ৩০০০ ঝাঁ চকচকে বিলাসবহুল রুম। নামী দামি ইন্টিরিয়রদের হাতে সেজে উঠেছে এই হোটেলের শয়নকক্ষগুলো। রাতের বেলায় বুর্জ খালিফার আলোর খেলা তো পৃথিবী বিখ্যাত। উত্তর কোরিয়ার এই হোটেলের দেওয়ালেও প্রতি সন্ধ্যায় ফায়ারওয়ার্কের লাইভ শো হয়ে থাকে, এক্কেবারে বুর্জ খলিফার মতোই। এই আলোর খেলা পুরো শহরটাকেই যেন মাতিয়ে তোলে রঙিন আলোয় রোশনাইয়ে। 


    নর্থ কোরিয়া এমন একটি দেশ যারা নিজেদেরকে ডেমোক্রেটিক বলে দাবি করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে এটি এমন একটি দেশ যেটি ১৯৪৮ সাল থেকে কেবলমাত্র একটি পরিবার চালিয়ে আসছে কিম পরিবার বিগত ৭৪ বছর ধরে এই কিম পরিবার জোর করে রাজত্ব করে চলছে। এদেশের নির্বাচন হয় ঠিকই কিন্তু নির্বাচনের ক্যান্ডিডেট শুধু মাত্র একজনই থাকে আর সেই ক্যান্ডিডেট হল নর্থ কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম পরিবারের একজন। তাঁরাই এ দেশে গণতন্ত্রের শেষ কথা। তার ফলে এই দেশের অনেক শত্রু রয়েছে আর অন্য দেশের সাথেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই আর না অন্য দেশ থেকে টুরিস্ট আসতে পছন্দ করে প্রতিবছর তিন লক্ষ বেশি ভিজিটের এখানে ঘুরতে আসে কিন্তু শুনে যদি মনে হয় এটি বেশি তাহলে তার পাশের দেশে সাউথ কোরিয়াতে ১৭৫ ল্যক্ষের বেশি লোক ঘুরতে আসে। তাহলে এই দেশে এত বড় হোটেলের কি দরকার চলুন জেনে নিন যখন 


১৯৮৬ সালের কথা, ইউনাইটেড স্টেট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে তখন। এই ঠান্ডা যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ নেয় উত্তর কোরিয়া। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া বেছে নেয় ইউনাইটেড স্টেট বা আমেরিকার পক্ষ। আগেই বলেছি ঠান্ডা যুদ্ধ, অর্থাৎ কোনওরকম অস্ত্রের ব্যবহার নয়, কেবলমাত্র কূটনীতির সাহায্যে নিজেদের ক্ষমতা তুলে ধরাই ছিল এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য। যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক, এই ঘটনার পর থেকেই একটা পাকাপাকি চিড় পড়ে যায় উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্কের মধ্যে। একে অপরের প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসাবে জেগে ওঠে তারা। প্রতিবেশীর বদলে কীভাবে যেন দুজনেই দুজনের শত্রু হয়ে যায়। শুরু হয় রাজনৈতিক ইগোর লড়াই। প্রত্যেক ক্ষেত্রে একে অপরের চেয়ে এগিয়ে থাকার চেষ্টা। নিজের রাজনৈতিক তথা কূটনৈতিক অবস্থানকে ধ্রুব দেখানোর প্রয়াস। আর দুই দেশের এই ইগোর প্রতিযোগিতায় বলি হয় হোটেল রিয়াংগং।


১৯৮৬ সাল নাগাদ সিঙ্গাপুরে সব থেকে উঁচু এক বিলাসবহুল হোটেল তৈরি করে দক্ষিণ কোরিয়া। যেটা আজ স্ট্যামফোর্ড হোটেল নামে পরিচিত। এছাড়াও সেসময় ১৯৮৮ সালের অলিম্পিকের জন্যও জোরকদমে প্রস্তুতি নিচ্ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। বলা চলে, পুরো পৃথিবীর নজর এসে পড়েছিল কারিয়া প্রণালীর পাশের এই দেশটার দিকে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবেশীর এই বাড়বাড়ন্ত মেনে নিতে পারছিল না উত্তর কোরিয়া। সেসময় নর্থ কোরিয়াতেও একটি বিশাল ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। প্রায় অলিম্পিকের সমতুল্য এই ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করতে ব্যয় হতে থাকে রাজকোষাগারের কোটি কোটি টাকা।

 ১৯৮৯ সাল নাগাদ এই উৎসব হওয়ার কথা ছিল। দেশ বিদেশ থেকে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন ২২০০০ অ্যাথলিট। সেইসময় দেড় লক্ষ লোক বসতে পারে এমন একটি ব্র্যান্ড নিউ স্টেডিয়াম এবং অংশগ্রহণকারীর জন্য ৩০০০ রুম বিশিষ্ট একটি হোটেল।

 এই হোটেলটি ১০৫ তলাবিশিষ্ট হওয়ার কথা ছিল, যা উচ্চতায় অনায়াসে ভেঙে দেবে দক্ষিণ কোরিয়ার স্ট্যামফোর্ড হোটেলের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। শুধু তাই নয়, সেই সময় গোটা পৃথিবীতে মাত্র একুশটি বিল্ডিং এমন ছিল যাদের উচ্চতা ১০০ তলার উপর। সোজা কথায় উচ্চতার হিসেবে সেসময় রিয়াংগং হোটেলই হতে পারত বিশ্বের সর্বোচ্চ হোটেল।


স্রেফ প্রতিযোগিতায় একটা দেশকে টেক্কা দেওয়ার জন্য তখন মরিয়া নর্থ কোরিয়া। বেশ জোরশোরসেই এই অভিনব নতুন হোটেলের ঘোষণা করে দিয়েছিল তারা। তখন কে জানত পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু হোটেল বানানোর স্বপ্নই একদিন কাঁটার মতো বিঁধে যাবে তাদের গলায়। এত উঁচু বিল্ডিং বানানোর জন্য যে পরিমাণ ইস্পাত প্রয়োজন, ততখানি পর্যাপ্ত স্টিল নর্থ কোরিয়ার ভাঁড়ারে মজুত ছিল না। এই হোটেলের একদম উপরের ফ্লোরের রেস্টুরেন্টে পৃথিবীর সবথেকে উঁচু অবজারভেশন ডেক বানানোর কথাও ছিল। হোটেল রিয়াংগং-য়ে যে আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগসুবিধে রাখার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, তা যদি সম্ভব হত তাহলে শুধুমাত্র সাউথ কোরিয়াকেই নয়, ইগো আর প্রযুক্তির লড়াইয়ে পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশকেই পিছনে ফেলে দিতে পারত উত্তর কোরিয়া। 


১৯৮৭ সালে হোটেলের কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু করা হয় বটে, কিন্তু ১৯৮৯ সালে যখন ওয়ার্ল্ড ফেস্টিভেল শুরু হয় তখন ৩০০০ রুমবিশিষ্ট এই হোটেলের নির্মাণকাজ অর্ধেকও শেষ হয়নি। তখন সম্মান বাঁচানোর জন্য টেকনিক্যাল সমস্যার দায় দিয়ে সেযাত্রা পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। অবশ্য এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নয় কিম পরিবার। হার না মেনে হোটেলের নতুন ওপেনিং ডেট ঘোষণা করে তাঁরা। সেই বিশেষ দিনটি ছিল আবার উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম উন সুনের ৮০ তম জন্মদিন সেটি ছিল ১৯৯২ সাল। হোটেলের সাইটের কাজ জোরকদমে চালু করা হয় আবার। কিন্তু ভাগ্য কোনওভাবেই সঙ্গ দিচ্ছিল না নর্থ কোরিয়াকে।



১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। যেহেতু ঠান্ডা যুদ্ধের গোড়া থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ছিল, তাই এই ভাঙনের প্রভাব একেবারেই এড়িয়ে যেতে পারেনি উত্তর কোরিয়া। টাকার অভাবে বিল্ডিংয়ের কনস্ট্রাকশনের কাজ শেষ হওয়ার আগেই তা স্থগিত করে দেওয়া হয়। হোটেলের ওপেনিং-এর যে আশ্বাস সবাইকে দেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয়বারের জন্যও ফেল হয়ে যায় তা। এর ফলে একদিকে যেমন অসমাপ্ত থেকে যায় রিয়াংগং হোটেলের নির্মাণকাজ, তেমনই অন্যদিকে পৃথিবী জুড়ে হাসিঠাট্টার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় উত্তর কোরিয়ার এই স্ফীতোদর দম্ভ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রাজধানীর বুকে একইভাবে একা একা দাঁড়িয়ে আছে রিয়াংগং হোটেলের স্ট্রাকচার। সৌন্দর্য বাড়ানোর পরিবর্তে একটি কালো দাগের মতো উত্তর কোরিয়ার কলঙ্কচিহ্ন এই হোটেল। একসময় এই সম্পূর্ণ স্ট্রাকচারটিকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে পুরো পৃথিবীর সামনে আরও বেশি কলঙ্কিত হতে হবে এই ভয়ে সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হঠতে হয় উত্তর কোরিয়া সরকারকে।


২০০৮ সাল নাগাদ রিয়াংগং নিয়ে নতুন করে চুক্তি করা হয় একটি ইজিপশিয়ান কোম্পানির সঙ্গে। সেই চুক্তি অনুসারে স্থির হয়, এই কোম্পানি তাঁদের নিজেদের অর্থ দিয়ে নির্মাণের অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করবে। হোটেলের পরিচালনার দায়িত্বেও থাকবে এই কোম্পানি। সেই সময় মারা গিয়েছিলেন নর্থ কোরিয়া সুপ্রিম লিডার কিম আল সাংতো। শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ঠিক করা হয় সুপ্রিম লিডারের ১০০ তম জন্মদিন অর্থাৎ ২০১২ সালে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে এই হোটেল।



ইজিপশিয়ান ঐ কম্পানি সর্বপ্রথম বিল্ডিংটিতে উইন্ডো প্যানেল লাগায়, যাতে ওটি শহরের সৌন্দর্য নষ্ট না করে। কিন্তু অন্দরসজ্জার কাজ শুরু করার সময় আরও একটি বড় সমস্যা দেখা দেয়। ২০১১ সালে কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার সিংহাসনে বসেই এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেন যার ফলে চটে গিয়ে নর্থ কোরিয়াতে বিলাসবহুল পণ্য রফতানি করা বন্ধ করে দেয় আমেরিকা। এর ফলে শুরু হয় নতুন সমস্যা। হোটেলের অন্দরসজ্জার জন্য যেসব আসবাবপত্রের প্রয়োজন হত তা নর্থ কোরিয়া আমদানি করতে পারছিল না।হোটেল উদবোধনের জন্য নির্দিষ্ট করা তারিখে আরও একবার বিশ্বের দরবারে মুখ পোড়ে উত্তর কোরিয়ার। পৃথিবীর সবথেকে উঁচু হোটেল হিসাবে যার বিশ্ব রেকর্ড করার কথা, সেই হোটেলের নাম গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ডে ওঠে বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কারণে। গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী এটি পৃথিবীর সব থেকে বড় বিল্ডিং, যা গত ৩০ বছর ধরে একদম খালি পড়ে রয়েছে। আজও এই হোটেলের দেওয়ালে রাতের বেলায় চমৎকার রঙিন আলো দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু হোটেল একদম খালি পরে রয়েছে।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad