ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Saturday 12 August 2023

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান

 


ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান


প্রেসকার্ড নিউজ ওয়ার্ল্ড ডেস্ক, ১১ আগস্ট: ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান প্রাচীন যুগের সপ্তাশ্চর্যের একটি। এই উদ্যানটিকে নিয়ে কবিরা লিখেছেন কবিতা, শিল্পীরা বেঁধেছেন গান, চিত্রকরেরা মনের মাধুরী মিলিয়ে এঁকেছেন অপূর্ব সব ছবি। শত শত গল্প কাহিনীর আধার হলেও বাস্তবে এই ঝুলন্ত উদ্যানের অস্তিত্ব নিয়ে ইতিহাসে কোনও পাকাপোক্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। নামে ঝুলন্ত উদ্যান হলেও ব্যাবিলনের উদ্যানটি কিন্তু ঠিক শূন্যে ভাসমান ছিল না বরং মরুভূমিতে মাটি ফেলে কৃত্রিম পাহাড় তৈরি করে সেখানে রোদে সেঁকে ইটের কলাম দিয়ে তৈরি করা হয় অনেকগুলি ধাপ। সেই পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে গাছপালা লাগানো হয়েছিল। দূর থেকে যা দেখলে মনে হতো শূন্যে রয়েছে বাগানটি। 


৪০০০ শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে তৈরি করেছিলেন এই বাগান। বাগান পরিচর্যার কাজে নিয়োগ করা হয় ১,০৫০ জন মালি। ৫ থেকে ৬০০০ ফুলের চারা রোপন করা হয়েছিল ওই ঝুলন্ত উদ্যানে। কিন্তু ঠিক কেন তৈরি করা হয়েছিল এই রাজসিক বাগানটি? প্রচলিত উপকথা অনুসারে ২৫০০ বছর, আগে ব্যাবিলন সম্রাট নেবুচান নেচার ছিলেন প্রেমিক স্বভাবের। নিনেভের রাজ্য দখল করার সময় মিডিয়ার সম্রাট তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। এরপর মিদিয়ার রাজকন্যা আমিতিসের রুপে আকৃষ্ট হয়ে নেবুচার নেচার তাকে বিয়ে করেন। 


মিদিয়া রাজ্য ছিল সবুজ পাহাড় আর মনোরম উপত্যকা দিয়ে ঘেরা। বিয়ের পর আমিতিস যখন ব্যাবিলনের রুক্ষ মরুভূমি অঞ্চলে আসলেন, তখন এখানকার প্রকৃতি দেখে তার মন খারাপ থাকতো। মরুময় পরিবেশ রাজকন্যার একটুও ভালো লাগেনি। ব্যাবিলনের মানিয়ে নিতে না পারায় আমিতিস গৃহকাতর হয়ে পড়লেন। তাকে খুশি করতে সম্রাট নেবুচান নেচার ঠিক করলেন বালির বুকে গড়ে তুলবেন এক টুকরো সবুজের বাগিচা। কিন্তু কাজটা ছিল অনেক অনেক কঠিন। একে তো মরুভূমির মাটি রুক্ষ, এমন জায়গায় গাছপালা কিভাবে জন্মাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন সবাই। আবার গাছ লাগালেও তার শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। এসব নানা ভাবনা সকলের মনে কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত সম্রাটের ইচ্ছাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে ডাকা হল বিশেষজ্ঞদের। তাদের সুচিন্তিত পরামর্শ ছিল যে, সেচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। 


এরপর শুরু হল পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা। সকলের পরামর্শ ও পরিকল্পনায় তৈরি হয়, ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান। তবে আধুনিক ইতিহাসবিদদের মনে প্রশ্ন ওঠে, ঠিক কোথায় তৈরি করা হয়েছিল এই বাগানটি? ধারণা করা হয় আজকের ইরাক দেশের ব্যাবিলন প্রদেশের হিল্লান নামক জায়গার কাছেই ছিল এই বাগান। তবে প্রথম খ্রীস্টাব্দে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলেই গবেষকরা মনে করেন। আবার কারও কারও মতে ৫১৪ খ্রীস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী পারস্য রাজ্যের সাথে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এই সুন্দর উদ্যানটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। অবশ্য এই বাগানটির আদৌ কোনও অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মনে সব সময় সন্দেহ ছিল। 


বেশিরভাগ গবেষকদের ধারণা, ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান বলতে আসলে কিছুই নেই। এটি কেবলই কল্পনা প্রিয় রোমান্টিক কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টি। ৪০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের দিকে ব্যাবেলিয়ন পুরোহিত বেরোসাস বাগানটির সম্পর্কে প্রথমে লেখেন। মূলত তার লেখার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে গ্রীক ইতিহাসবিদরা এই বাগান সম্পর্কে নানা কথা রচনা করেন, যাদের কেউই বাগানটি নিজ চোখে দেখেননি। ঐতিহাসিকদের মতে ব্যাবিলনের ইতিহাসে তো বটেই স্বয়ং নেবুচান নেচারের লিপিতেও কোথাও এই বাগানের কথা উল্লেখ নেই। 


আবার অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান আসলেই ব্যাবিলনের ছিল না, এটি ছিল ইরাকের প্রাচীন সাম্রাজ্য অ্যাসেডিয়ান নগরী নিনেফেতে। তবে এ দাবীয স্বপক্ষে শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 


আবার অন্য ইতিহাসবিদদের মতে বাগানটিতে জল তুলতে যে যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া হয় বলে মনে করা হয়, সেসময় সেগুলোর অস্তিত্বই ছিল না। কেউ কেউ মনে করেন, ইউফ্রেটিস নদী থেকে জল তুলতে স্ক্রু পাম্প ব্যবহার করা হতো। তবে ধারণাটি তেমন একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ এই পাম্প আবিষ্কার হয়েছে আরও অনেক পরে। 


এতসব বিতর্কের পর ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান সম্পর্কে কিছুটা আশা দেখান জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক রবার্ট কোল্ডোওয়ে। ১৮৯৯ সালে তিনি ব্যাবিলন শহরে খনন কাজ শুরু করেন এবং রাজা নেবুচান নেচারের প্রাসাদ, দুর্গ, টাওয়ার অফ ব্যাবিলন ও নগর রক্ষাকারী দেওয়াল আবিষ্কার করেন। খননের শেষ দিকে তিনি ১৪ কক্ষ বিশিষ্ট একটি স্থান খুঁজে পান, যার ছাদ ছিল পাথরের তৈরি। ব্যাবিলনের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী, উত্তর দিকে দুর্গ এবং ঝুলন্ত উদ্যান ছাড়া আর কোথাও ছাদ তৈরিতে পাথরের ব্যবহারের কথা উল্লেখ ছিল না। উত্তর দিকে দুর্গ তিনি আগেই খুঁজে পাওয়া এই স্থানটির ঝুলন্ত বাগান ছিল বলে দাবী করেন। এমনকি তিনি সেচের জন্য ব্যবহৃত চেন পাম্পের কক্ষ খুঁজে পান, যা বাগানটির অস্তিত্বের স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ দেয়। 


তবে পরবর্তীকালের গবেষকদের মতে কোল্ডোওয়ের এই দাবী ভুল ছিল, কারণ যে অংশটি তিনি ঝুলন্ত বাগান বলে দাবঘ করেছিলেন তা নদী থেকে অনেক দূরে। পূর্বের ইতিহাসবিদরা বাগানের অবস্থান সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে এটি মানানসই নয়। এত দূর থেকে জল সরবরাহ করা ছিল অসম্ভব। তাছাড়া অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে এই অংশটি কোনও উদ্যান হিসেবে নয় বরং প্রশাসনিক কাজকর্ম ও স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। 


শত শত বছর পরে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান সত্যিই ছিল কিনা তা এখনও নিশ্চিত করা বলা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা মানুষের কৌতুহল আর একে ঘিরে নানা কাল্পনিক গল্পকে আটকে রাখতে পারেনি। কে বলতে পারে অনগত কালে হয়তো ইউফ্রেটিসের কোনও প্রান্তে মিলে যাবে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের অস্তিত্ব!

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad