খুনের দায়ে হাতিকে মৃত্যুদণ্ড! ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Thursday 17 August 2023

খুনের দায়ে হাতিকে মৃত্যুদণ্ড! ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায়

 


খুনের দায়ে হাতিকে মৃত্যুদণ্ড! ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায়



প্রেসকার্ড নিউজ ওয়ার্ল্ড ডেস্ক, ১৭ আগস্ট: কোনও মানুষ যখন কোনও জঘন্য অপরাধ করে, তখন তাকে মৃত্যু দন্ডের শাস্তি দেওয়া হয়। এমনকি জঘন্য অপরাধ করার পরেও আইনের ফাঁকে বা মানবতার দোহাই দিয়ে সেই মানুষটির মৃত্যুর দন্ড বাতিল করে দেওয়া হয়। কিন্তু ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা আছে যেটি জানলে আপনারও চোখে জল চলে আসবে।


আজ থেকে প্রায় ১০৬ বছর আগে আমেরিকায় একটি প্রাণীকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। আর যে কারণে মৃত্যুর দন্ড দেওয়া হয়েছিল তাতে তার কোনও দোষ ছিল না। তাকে বাধ্য করা হয়েছিল ওই ভুলটি করার জন্য। ওই প্রাণীটি ছিল সার্কাসের খেলা দেখানো একটি হাতি যার নাম ছিল মেরি বা ম্যারি। 


শান্ত স্বভাবের মেরি নামের সেই হাতির সাথে সেদিন এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল, যে সে নিজের অজান্তেই তার মাহুতকে হত্যা করেছিল। আর এই কাজের জন্য সেই এলাকার জনগণ তাকে ক্ষমা করতে পারেনি বরং তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসির সাজা দিয়েছিল। আর এই দৃশ্য সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা আড়াই হাজার মানুষ দেখেছিলেন এবং হাততালি দিয়েছিলেন। এবার প্রশ্ন হল মেরি নামে হাতিটির সাথে কি হয়েছিল? সে কেন তার মাহুতকে হত্যা করেছিল? জেনে নেওয়া যাক ইতিহাসের সেই জঘন্য ঘটনা সম্পর্কে -


মেরি নামের এই হাতেটি কাহিনী শুরু হয়েছিল ১৯০০ সালের শুরুর দিকে। সে সময় আমেরিকা জুড়ে অনেক সার্কাস শো হতো, যাতে বিভিন্ন ধরনের পশুদের ধরে নিয়ে আসা হতো এবং তাদের নিয়ে খেলা দেখানো হতো। এমন একটি সার্কাস দলের নাম ছিল স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাশ শো। এই সার্কাসে মাত্র চার বছর বয়সের মেরিকে নিয়ে আসা হয়েছিল। মেরি ছিল এশিয়ান প্রজাতির হাতি। এত অল্প বয়সে হাতিটিকে তার পরিবার থেকে ছিনিয়ে আনার পর শুরু হয়েছিল তার ট্রেনিং। 


তবে এই সার্কাসের যে মালিক ছিলেন চার্লি স্পার্কস, তিনি মেরিকে খুব ভালোবাসতেন। ধীরে ধীরে মেরি বড় হয়, অন্যান্য হাতির থেকে মেরির বুদ্ধি যেমন বেশি ছিল, তেমন সে শান্ত প্রকৃতির ছিল। তবে তার আকার অনেক বড় হওয়ায় তাকে সবাই বিগ মেরি বলে ডাকতো। ট্রেনিং সম্পন্ন হলে ম্যারিকে দিয়ে বিভিন্ন রকমের খেলা দেখানো হতো; যেমন- মাথার ওপর ভার দিয়ে দাঁড়ানো, কোনও বাজনা বাজানো, ফুটবল খেলা। আর মেরির এসব খেলা দেখতে সার্কাসের লোকজন উপচে পড়ত। এইভাবে বেশ কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে।


একবার এই সার্কাস দলটি যায় আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে একটি শো করতে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগে একটি সমস্যা দেখা দেয়। মেরির দেখাশোনা করার জন্য যে মাহুতকে রাখা হয়েছিল, তার সাথে সার্কাসের মালিকের একটু ঝামেলা হয়, আর সেই ঝামেলার জেরে সেই মাহুত কোন সময় না দিয়েই কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। ফলে মেরির দেখাশোনা নিয়ে একটি বড় সমস্যা দেখা দেয়। কারণ মেরিকে ছাড়া সার্কাসের লোক টানা সম্ভব না। সেই ছিল সার্কাসের প্রধান আকর্ষণ। তখন মাহুতের কাজের খোঁজে রেড এলড্রিজ নামের এক লোক আসেন। তবে রেড নামের এই লোকটিকে আগে মাহুত হিসেবে কাজ করার বেশি দিনের এক্সপেরিয়েন্স ছিল না। 


এদিকে শো-এর দিন ঘনিয়ে আসছিল। শেষে রেডকেই কাজে নিয়োগ করা হয়। তবে তাকে বারবার সাবধান করে দেওয়া হয় যাতে কোনও ভাবে হাতিকে রাগানো না হয়। নইলে ভিড়ের মধ্যে রেগে যাওয়া হাতি অনেক বড় দুর্ঘটনা বাঁধিয়ে দিতে পারে। তবে রেডের সাথে মেরির বন্ডিংটা ঠিকভাবে তৈরি হতে পারেনি। ম্যারির শান্ত স্বভাবের হলেও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করালে সে রেগে যেত। এটা রেড বুঝতে পারত না।


১৯১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সার্কাসে শো শুরু হয়। লোকজনও উপচে পড়েছিল সেই শোতে। আর মেরি প্রতিদিনের মতো খেলা দেখাতে শুরু করে। হাতির খেলা দেখে লোকজনও খুব আনন্দ নিচ্ছিল। এমন সময় মেরির চোখে পড়ে পাশে থাকা একটি তরমুজের দিকে। সে আচমকারী খেলা বন্ধ করে সেই তরমুজ খেতে শুরু করে। এদিকে মেরি থেমে যাওয়ায় দর্শকরা চিৎকার করতে থাকে। কারন তারা টাকা দিয়ে খেলা দেখতে এসেছিল। সেসময় মেরির ওপরে বসে ছিল তার নতুন মাহুত রেড এল্ডিজ।দর্শকদের চেঁচামেচিতে রেড মেরিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেয়ে যায়। উপায় না দেখে সে তার হাতে থাকা লোহার হুক দিয়ে মেরির মাথার ওপরে এবং কানের পেছনে বারবার আঘাত করতে থাকে। ‍


মেরির প্রথম দিকে মাথা ঝাঁকা দিয়ে আর শুঁড় তুলে আওয়াজ করে রেডকে সাবধান করে দেয়। কিন্তু ততক্ষণের রেড ভুলে যায় তার ট্রেনিংয়ের কথা। সে এবার এলেপাথারি হুক দিয়ে মেরিকে আঘাত করতে থাকে আর পা দিয়ে মেরির কানে লাথি মারতে থাকে, যাতে সে আবার খেলা দেখানো শুরু করে। এদিকে বারবার সাবধান করা সত্ত্বেও রেড মেরিকে আঘাত করছিল তখন শান্ত মেরি একটি ভয়ংকর আওয়াজ করে এবং মুহূর্তের মধ্যে রেড কে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে আর সুরের সাহায্যে শূন্যে তুলে তাকে মাটিতে আছড়ে দেয় এবং নিজের পা দিয়ে রেডের মাথা থেঁতলে দেয়।


ইতিমধ্যে দর্শকদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে। যায় যারা একটু আগে মেরি মেরি বলে আনন্দে চিৎকার করছিল, তারা এখন খুনি মেরি বলে চিৎকার করতে থাকে। কোনও মতে তখন ম্যারিকের শান্ত করা হয় আর সেসময়ের কথা বলা হয়েছে যে সময় কোনও সার্কাসের জন্তু একটি ভুল করলেই তাকে কোন সার্কাস বা চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দেওয়া হতো। আর সেখানে ম্যারি একজন লোককে মেরে ফেলেছিল। ফলে লোকজনের মধ্যে ম্যারিকে নিয়ে আক্রোশ বাড়তে থাকে। 


খবরের কাগজে ম্যারির নাম দেওয়া হয় খুনি ম্যারি। আর লোকজনের এটেনশন পেতে তারা মিথ্যে খবর ছাপায়; বলা হয়, ম্যারি নাকি এর আগেও কয়েকবার খুন করেছিল। এতে লোকজন ম্যারির শাস্তির দাবী করতে থাকে আর যদি তাকে শাস্তি না দেওয়া হয় তাহলে তারা সার্কাসের শো বয়কট করবে। এমনকি সার্কাসের লোকজন শহর ছেড়েও যেতে পারবেনা। সার্কাসের মালিক চার্লি স্পার্কস বুঝে যান ম্যারিকে শাস্তি দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আর লোকজনের সে সময় যে রাখছিল সে রাগ দেখে ঠিক করা হয় ম্যারিকে জনসম্মুখে ফাঁসি দেওয়া হবে।


সেইমতে ১৯১৬ সালের ১৩ ই সেপ্টেম্বর সার্কাসের পাশে থাকা একটি রেল স্টেশনের কাছে ম্যারিকে নিয়ে আসা হয় ফাঁসি দেওয়ার জন্য। সেখানে একটি বড় ক্রেন নিয়ে আসা হয়। ধীরে ধীরে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ জড়ো হয়। এরপর ম্যারির অপরাধের কথা সবাইকে জানানো হয়, ম্যারির অপরাধের কথা শুনে লোকজন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এরপর ম্যারির গলায় পড়ানো হয় লোহার শিকল, ক্রেন দিয়ে সেই গলার ফাঁস লাগানো শিকল ধরে ম্যারিকে প্রায় ২০ ফুট উঁচুতে তুলে ধরা হয়। নিরীহ ম্যারি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। 


কিন্তু এরই মধ্যে তার ভারে ছিঁড়ে যায় সেই শিকল আর ২০ ফুট উঁচু থেকে ম্যারি নিচে পড়ে যায়। এই মুহূর্তে তার মেরুদন্ড ভেঙে যায়, কেটে যায় শরীরের বেশ কিছু জায়গায়। কিন্তু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা ম্যারিকে দেখে কারও মনে একটুও মায়া হয় না।ফলে আবার তার গলার শিকল বেঁধে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এবার টানা ৩০ মিনিট, ম্যারির নিথর দেহ শূন্যে ঝুলতে থাকে।


যে প্রাণীটা মাত্র চার বছর বয়সে নিজের পরিবার ছেড়ে এসেছে, সারা জীবন দর্শকদের মনোরঞ্জন করে এসেছিল, সেই দর্শকরা তার মৃত্যুতে পরম শান্তি অনুভব করছিল।


সারা বিশ্বের এই খবর যখন ছড়ায় তখন এই জঘন্য ঘটনার নিন্দা হয়। কিন্তু তাতে কি আর মেরির জীবন ফিরে আসবে! এরপরে ওই সার্কাস চলতে থাকে বিভিন্ন এলাকায়। মানুষ আবার তাদের জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু এই ঘটনা আজও মানবজাতির কাছে অপমান হয়ে রয়ে গেছে।

 

বনে থাকা পশুদের দিয়ে মনোরঞ্জন করানোর জন্য তাদের জীবনকে আমরা নরক বানিয়ে দেই। তাদের চিড়িয়াখানায় বন্দি করে রাখি, আবার সার্কাসের রিং মাস্টারের ছরির তালে তাদের নাচাতে চাই। ইচ্ছা না হলেও প্রাণীগুলোকে সেই কাজ করতে হয় আর যদি তারা প্রতিবাদ করতে যায়, তাহলে তাদের অবস্থা হয় মেরির মতো।


আচ্ছা আপনার কি মনে হয় সেদিন কি দোষ ছিল ম্যারির? নাকি সেই মানুষগুলোর? যারা নিজেদের রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল! কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানান।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad