ব্রিটিশ আমলের পাখাওয়ালাদের করুণ কাহিনী - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Monday 7 August 2023

ব্রিটিশ আমলের পাখাওয়ালাদের করুণ কাহিনী


 ব্রিটিশ আমলের পাখাওয়ালাদের করুণ কাহিনী 




প্রেসকার্ড নিউজ লাইফস্টাইল ডেস্ক, ০৭ আগস্ট: ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতে রাজত্ব করেছিল। আর এই ২ শো বছর তারা যে শুধু মাত্র ভারতের হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুট করেছে তা কিন্তু নয় বরং তারা নিরীহ ভারতীয়দের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। ইংরেজরা যখন প্রথম ভারতে এসে রাজত্ব করতে শুরু করে তখন তাদের প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভারতের আবহাওয়া। ভারতের অত্যধিক গরমে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। আর প্রতিবারের মতো এবারও এই সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য নিরীহ ভারতীয়দের ব্যবহার করে। 


ইংরেজরা যখন ভারতে এসেছিল বৈদুতিক পাখা তখনও আবিষ্কার হয়নি। তাই অতিরিক্ত গরম থেকে বাঁচার জন্য তারা কয়েকজন লোককে সব সময় পাখা চালানের জন্য রেখে দিতেন, তাদের বলা হয় পাখাওয়ালা। তবে পাখাওয়ালাদের চাকরি কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। তাদের ওপর ইংরেজরা প্রতিনিয়ত অত্যাচার করত। কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া পাখাওয়ালাদের সেই নির্মম কাহিনী নিয়েই এই প্রতিবেদন। 


আজ কালকার দিনে যখন আমাদের গরম লাগে, গরম থেকে মুক্তি পেতে আমরা শুধুমাত্র একটি সুইচ অন করে পাখা চালিয়ে নিতে পারি। এমন একটা সময় ছিল যখন পাখা নামের কোনও জিনিসের অস্তিত্বই ছিল না। তবে যুগ যুগ ধরে এই আবহাওয়া ভারতীয়দের সয়ে গেছে। কিন্তু ইংরেজরা যখন ভারতে আসে, তখন ভারতের এই গরম আবহাওয়া তাদের সহ্য হচ্ছিল না। আর এই জন্য সেই সময় তারা পাখার ব্যবহার শুরু করে। তখন পাখা তৈরি হত কাঠের ফ্রেম আর কাপড় দিয়ে। এই পাখাগুলো চালানো জন্য সব সময় কিছু লোক রাখা হত, যাদের পাখাওয়ালা নাম দেওয়া হয়েছিল। 


তাদের সারা দিন এক নাগাড়ে একটি দড়ির সাহায্যে পাখা চালিয়ে যেতে হবে। তাদের এক মূহুর্তের জন্য থামার অনুমতি ছিল না। যদি পাখাওয়ালা ক্লান্ত হয়ে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য পাখা চালানো বন্ধ করে দিত, তাহলে ইংরেজদের আরামে ব্যাঘাত ঘটতো। আর এজন্য পাখাওয়ালাদের কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি পেতে হত। এ ধরনের পাখাকে তখন কার দিনে লাকজারি সিম্বল বা বিলাসিতার প্রতীক ভাবা হত। ইংরেজদের উচ্চ পদস্থ শাসন কর্তার বাড়ি, প্রশাসনিক কার্যালয়, কোর্ট রুম এসব জায়গায় এ ধরনের পাখা লাগানো হত। এক একটি পাখা চালাতে অনেক সময় ২ জন বা ৩ জন লোকের দরকার পড়ত। এই কাজ করার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শক্তিশালী এবং বধির বা কানে কালা লোকেদের রাখা হত। 


শক্তিশালী লোকেদের রাখার কারণ ছিল এ ধরনের পাখা টানার জন্য হাতে বেশ শক্তি প্রয়োজন হত। আর হাতে যত জোর, তত ভালো হাওয়া। আর বধির বা কালা লোকেদের কাজে রাখার কারণ ছিল ইংরেজরা যাতে তাদের কোনও গুপ্ত কথা অনায়াসে তাদের সামনে আলোচনা করতে পারে। এতে তাদের গোপন কথা বাইরের লোকেদের কান পর্যন্ত পৌঁছোনোর কোনও সুযোগ থাকতো না। যদি কোনও পাখাওয়ালা স্বাভাবিকভাবে কালা না হত, তখন তাদের কানের মধ্যে ভালো ভাবে তুলো গুঁজে দেওয়া হত। আর ঘরের দেওয়ালে একটি ছোট ফুটো করে সেখান থেকে পাখার দড়ি বাইরে বের করে দেওয়া হত। আর ঘরের বাইরে বসে পাখাওয়ালা লোকটিকে অনবরত তার কাজ করতে হত। 


এই পাখাওয়ালাদের কাজ মোটেই সহজ ছিল না, যতটা শুনে মনে হচ্ছে। হয়তো ভাবতে পারেন, দিন মজুরি করা বা মাঠে কাজ করার থেকে এই পাখা টানার কাজ তো অনেক সহজ। কেননা এদের সারাদিন ঘরের এক কোনায় বসে শুধু পাখাটাই চালাতে হয়। তবে ব্যাপারটা কিন্তু আসলে অতটা সহজ নয়। দড়ি টানতে টানতে যদি কোনও কারণে পাখাওয়ালা ক্লান্ত হয়ে যেত আর কিছু সেকেন্ডের জন্য পাখা চালানো বন্ধ করে দিত, তাহলে ইংরেজ সৈন্যদের দিয়ে তাদের বেধড়ক মারধর করা হত। পাখাওয়ালাদের পুরো দিন কোনও খাবার বা পানীয় দেওয়া হত না। কোনও কোনো দিন তো এমনও হত, যে পাখাওয়ালা কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ক্ষিদে এবং তেষ্টায় অজ্ঞান হয়ে যেতেন। তখনও ইংরেজদের তাদের প্রতি কোন করুনা হত না বরং ওই লোকদের ওই অবস্থাতে ফেলে রেখে আবার অন্য লোকদের দিয়ে পাখা চালানো কাজ করানো হত। 


কিছু কিছু উচ্চ পদস্থ ইংরেজ কার্যকর্তার বাড়িতে অনেক সময় ১০ জনেরও বেশি পাখাওয়ালা মজুর থাকতেন। ওই ইংরেজ কর্মীরা তাদের শোওয়ার ঘর, বসার ঘর, রান্নার ঘর, খাবার ঘর, এমনকি স্নান করার ঘরেও পাখাওয়ালা মজুর রাখতেন। আর সব ঘরে পাখা চালানোর জন্য আলাদা লোক রাখা হত। এই পাখাওয়ালা চাকরির জন্য সবসময় গরীব এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের বেছে নেওয়া হত, যাতে তাদের ওপর ইংরেজরা নিজেদের ইচ্ছে মতো অত্যাচার করতে পারে এবং তাদের দিয়ে নিজেদের মতো খাইফরমাস খাটাতে পারে। সারাদিন খিদে তেষ্টা সহ্য করে দড়ি টেনে যাওয়ার কাজ যে কতটা কষ্টকর হয় আর এই পরিস্থিতিতে কি ধরনের যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে সেটা একমাত্র তারাই জানেন, যারা এই কষ্টটা অনুভব করেছেন। 


এটা সেই সময়ের কথা, যে সময় মেন্টাল হেল্থ বা মানসিক যন্ত্রণা আসলে কি সেই ব্যাপারে মানুষের কোনও ধারণাই ছিল না। তবে ইংরেজরাই প্রথমে এই ধরণের পাখা আবিষ্কার করেছিল, একথা ভাবার কারণ নেই। এই ধরনণের পাখার চল ইংরেজদের থেকেও বেশি পুরোনো। আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে গ্রিক এবং রোমানদের যুগে বড় বড় পাতার সাহায্যে হাওয়া করা হত আর এই পাখা গুলো দিয়ে হাওয়া করার জন্য এক একটি দলকে কাজে রাখা হত। এশিয়াতে সবচেয়ে প্রথম জাপানে হাত পাখার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। মোটামুটি ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে হাত পাখার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। যেটাকে একমেয়োগি বলা হত। এখনও জাপানের অনেক ঐতিহাসিক সংগ্রহশশালায় এই ধরণের পাখা দেখতে পাওয়া যায়। 


মধ্যযুগের শুরুতে ইউরোপের অনেক দেশে এই হাত পাখা গুলোর চলন শুরু হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে এই পাখা গুলো ইউরোপ ও এশিয়ায় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জাপান থেকে ইউরোপীয় বণিকরা এই হাত পাখা প্রথম ভারতে নিয়ে আসে। কিন্তু প্রথম থেকেই এই হাত পাখাগুলি উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মী এবং বনেদি বাড়ির লোকেরাই বেশি ব্যবহার করতেন। কেননূ সেই সময় হাত পাখা ব্যবহারের জন্য মজুরের দরকার পড়ত। আর কেবলমাত্র ধনী এবং ক্ষমতাশালী লোকেরা গরীব মানুষদের হুকুম চালিয়ে এই ধরণের কাজ করাত। তবে এই পাখাগুলোর চল কিন্তু বেশী দিন ছিল না। ১৯০০ সালের দিকে পৃথিবীতে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়, সেটা হল প্রথমবার বিদ্যুৎ চালিত পাখার আবিষ্কার। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতে এই বিদ্যুৎ চালিত এই পাখার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর এরপর থেকে ধীরে ধীরে পাখাওয়ালাদের চল বন্ধ হয়ে যায়।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad