বৈকাল হ্রদ: সাইবেরিয়ার মুক্তা
প্রেসকার্ড নিউজ ওয়ার্ল্ড ডেস্ক, ০৮ আগস্ট: লেক বৈকাল বা বৈকাল হ্রদ পৃথিবীর এক রহস্যময় জলধার। রাশিয়ার সাইবেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এই হ্রদের অবস্থান। অনন্য বৈশিষ্ট্যের এই হ্রদে জমা আছে পৃথিবীর সমস্ত বিশুদ্ধ জলের ২০ শতাংশ। মজার বিষয় হল প্রতি ৩৮৩ বছর পরপর নীচ থেকে এই লেকের জল সম্পূর্ণ পরিশোধিত হয়ে যায়। বৈকাল হ্রদ সম্পর্কে এমনই সব তথ্য দিয়ে সাজানো এই প্রতিবেদন।
স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে বৈকাল হ্রদের পৌরাণিক মর্যাদা রয়েছে। তাদের কাছে জলধারাটি অত্যন্ত পবিত্র। তারা বিশ্বাস করেন, স্বয়ং যীশুখ্রীষ্ট প্রাচীন বৈকাল হ্রদ অঞ্চল ভ্রমণে এসেছিলেন। তবে, ইতিহাসের পাতা ঘেটে জানা যায়, খ্রীষ্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতকে মানুষ সর্ব প্রথম বৈকাল হ্রদ আবিষ্কার করেন। ইউরোপীয়দের মাঝে ১৬৪৩ সালে প্রথম এই অঞ্চলে পা রেখেছিলেন রুশ নাগরিক কুর্বাত ইভানুভ। এই পরিব্রাজক এখানে এসে জন বসতির অস্তিত্ব দেখে অবাক হয়ে যান।
বৈকাল হ্রদের নামকরণ নিয়ে খানিকটা ধোঁয়াশা রয়েছে। সম্ভবত তুর্কী শব্দ বাই থেকে বৈকাল হ্রদের নামের উৎপত্তি, এর অর্থ সমৃদ্ধ হ্রদ। আবার কারও মতে মঙ্গলীয় শব্দ বৈকাল বা বৈকাল দালাই থেকেও এর উৎপত্তি হতে পারে। এই শব্দের অর্থ একটি সমৃদ্ধ বড় হ্রদ। হ্রদের তীরে বসবাসকারী লোকেরা তাদের নিজস্ব ভাষায় বৈকাল হ্রদকে লামু বোরিয়াতস বৈকাল মুন নামেও ডেকে থাকেন।
আদিবাসীদের বিশ্বাস মতে, এই হ্রদ ঐশ্বরিক। এই বিশাল হ্রদটি কৃত্রিম ভাবে তৈরি কোনও হ্রদ নয় বরং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট। এই হ্রদের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় ধারণা করা হয় প্রাথমিক ভাবে বৈকাল হ্রদ অঞ্চল ছিল একটি নদীর খাদ। কিন্তু ভূমিকম্প এবং ভূ-পৃষ্ঠের ফাটলের কারণে নদীর গভীরতার সাথে সাথে প্রশস্ততা বাড়তে থাকে। কোটি কোটি বছর আগে নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে একাধিক স্বতন্ত্র হ্রদ সৃষ্টি হয়। এরপর সেগুলো ধীরে ধীরে একত্রিত হয়ে জন্ম হয় বৈকাল হ্রদের। হ্রদগুলো একত্রিত হওয়ার পেছনে ভূমিকম্প, ভূমিধস এবং শিলা পতনের ভূমিকা আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
প্রাগ ঐতিহাসিক যুগের মতো আজও বৈকাল অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ। হ্রদের অভ্যন্তরীণ উপত্যকায় প্রতি বছর ২ হাজারের মতো হালকা এবং মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর ফলে হ্রদের গভীরতাও কম-বেশী বাড়তে থাকে বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা।
সুগভীর বৈকাল হ্রদের বিশাল অঞ্চলে জলের যোগান দিয়ে আসছে প্রায় ৩৩০ টির মতো নদী। তবে অবাক করার তথ্য হচ্ছে, এতগুলো নদীর জল এখানে এসে স্রোতের অববাহিকা অনুসরণ করে পতিত হয় আঙ্গারা নদীর বুকে। এমনকি বৈকাল হ্রদের মধ্যে ছোট বড় প্রায় ৩০ টি দ্বীপ রয়েছে।
গ্রীষ্মকালে এখানকার গড় তাপমাত্রা থাকে ১৪ ডিগ্রি। অপরদিকে শীতকালে এই তাপমাত্রা শূন্যের ১৯ ডিগ্রি নীচে নেমে যায়, যার ফলে এ সময় পুরো হ্রদটি বরফে ঢেকে যায়। বরফের এই আস্তরণ এতটাই শক্ত ও পুরু হয় যে, এর ওপর দিয়ে ১৫ টন ওজনের গাড়ি অনায়াসে ছুটে চলতে পারে। এই বরফের আস্তরণের ওপর হাঁটা-চলা ও স্কেটিং করেন অসংখ্য মানুষ। বিশেষ করে শীতকালে জল জমে বরফে পরিণত হলে, সেখানে বিশালাকার বলয় দেখা দেয়। এই বলয়কে এখানকার অধিবাসীরা অতন্ত পবিত্র বলে মনে করেন। এই অধিবাসীরা নানান উপায়ে হ্রদকে ঘিরে বিভিন্ন রীতিও পালন করে থাকেন।
বৈকাল হ্রদের জল অতিরিক্ত স্বচ্ছল হওয়ার কারণে বরফের আস্তরণের ওপর দিয়ে হ্রদের ভেতরের অংশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। ফলে বৈকালের তলদেশে মাছের বিচরণ করা ও সবুজ পাথরের দৃশ্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
বৈকাল হ্রদ জীববৈচিত্র্যেরও আধার। প্রায় ১,৮০০ প্রজাতির পশুপাখি এই অঞ্চলে পাওয়া যায়। বৈকাল হ্রদের আশেপাশের বনে বসবাসকারী প্রাণীদের মধ্যে বাদামী ভাল্লুক, উলফারিন, কস্তুরি হরিণ, শিয়াল, কাঠবিড়ালি দেখতে পাওয়া যায়।
বৈকাল হ্রদকে অবলম্বন করে প্রায় ২৩৬প্রজাতির পাখি বাস করে, যার মধ্যে ২৯ টি প্রজাতি জলজ পাখি। এখানে প্রচুর পরিমাণে হাঁস পাওয়া যায়। এছাড়াও রাজহাঁস, গ্ৰে-হেরণ, কালো গলা যুক্ত লুন, সোনালী ঈগলের মতো পাখি দেখতে পাওয়া যায় এই অঞ্চলে। এখানকার জলজ এবং স্থলজ প্রানী গুলোর অধিকাংশই আঞ্চলিক বা এনডেনিক। অর্থাৎ পৃথিবীর অন্য কোথাও এদের দেখতে পাওয়া যায় না। এজন্য প্রাণী প্রেমী এবং গবেষকদের কাছে বৈকাল এক সমৃদ্ধ জীবভাণ্ডার।
বৈকাল হ্রদের জলে আবার প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছের বসবাস। হ্রদে বসবাসকারী ২৭ প্রজাতির মাছ পৃথিবীর অন্য কোনও জলাধারে পাওয়া যায় না। সারা বিশ্বের একমাত্র সাধু জলের শিল, লেরপা শুধু মাত্র বৈকাল হ্রদেই পাওয়া যায়। এই হ্রদের প্রায় লক্ষ খানেক লেরপা ঠিক কখন সাগরের লবণাক্ত জলের থেকে বৈকালের সাধু জলে মিশে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে, তা উৎঘাটন করতে গিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা।
বিশাল হ্রদটিতে কেবলমাত্র প্রাণী নয়, এখানকার উদ্ভিদ জগৎও ভীষণ রকম সমৃদ্ধ। এই জলাধারে প্রায় হাজারটির ও বেশী উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। এই অঞ্চলের বনগুলিতে প্রচুর পরিমাণে সাইবেরিয়ান সিডার এবং লারচ রয়েছে। বৈকাল হ্রদে প্রায় ২১০ প্রজাতির শৈবাল ভেসে বেড়ায়।
সাইবেরিয়ার মুক্তা খ্যাত এই হ্রদের পূর্ব পাশে বসত করে বুরিয়াক নামক আদিবাসী। তাদের জীবন-জীবিকা প্রতক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বৈকালের ওপর নির্ভরশীল। এদের মধ্যে অনেকেই বৈকাল হ্রদে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এই বিশাল হ্রদ থেকে বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন টন মাছ সংগ্রহ করা হয়। বুরিয়াক ছাড়াও বৈকালের আশে পাশে আরও বেশ কয়েক ধরনের আদিবাসী বসবাস করেন। যাদের জীবন জীবিকা বৈকালের ওপর নির্ভরশীল। তাই বৈকাল হ্রদকে সাইবেরিয়ার আশীর্বাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
বর্তমানে এর আশে পাশে উদ্ভিদ ও বৃক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাগজ ও ভেষজ ঔষধি কারখানা। চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বাড়ছে কলকারখানার সংখ্যা। এসব কলকারখানা জলের জন্য বৈকাল হ্রদের ওপর নির্ভরশীল। এই কারণে ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে বৈকালের সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্য। তবে, আশার কথা হচ্ছে ১৯৯৬ সালে বৈকাল হ্রদকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর ভুক্ত ঘোষণা করে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে বিশাল এই অঞ্চলকে সংরক্ষণ করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে বৈকাল হ্রদকে বাঁচাতে ইতি মধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বৈকালের জৌলুস বজায় রাখার জন্য কয়েক বার আহ্বান করছেন। তিনি বৈকালের বর্তমান দূষণ কমানো, একে আরও পর্যটক বান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য নির্দেশও দিয়েছিলেন। বৈকাল হ্রদ কেবল রাশিয়ার নয়, সমগ্ৰ পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ জলাধার। তাই এটি রক্ষা করা সমস্ত বিশ্ব বাসীর দায়িত্ব।
No comments:
Post a Comment