৪ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল ছোট্ট চড়াই! - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Saturday 19 August 2023

৪ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল ছোট্ট চড়াই!

 


৪ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল ছোট্ট চড়াই!




প্রেসকার্ড নিউজ ওয়ার্ল্ড ডেস্ক, ১৮ আগস্ট: চড়ুই একটা ছোট শান্তি প্রিয় পাখি। কিন্তু ছোট চড়ুই পাখি একবার চার কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে ভুল করেই আমরা নতুন কিছু শিখি, কিন্তু যখন একটা দেশের সরকার ভবিষ্যতের চিন্তা না করে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটাকে কিন্তু ভুল বলা যায় না, বলা হয় বোকামি। যার ফল ভোগ করতে হয় দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষকে।


সময়টা ছিল ১৯৫৮ সাল, তখন চীনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাওজেদং। ১৯৫৮ সালের চীন আজকের মত এত উন্নত ছিল না তখন চীন খুবই গরিবের একটা দেশ ছিল। যেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫ কোটি, যারা মূলত কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু চীনে সেই সময় খাদ্যের অভাব ছিল। তারা যে পরিমাণ ফসল উৎপাদন করত, তাতে মোটামুটি তাদের দেশের ফসলের যোগান তো হয়ে যেত, কিন্তু দেশের বাইরে সেই ফসল বিক্রি করে কিছু অর্থ উপার্জন করবে, সেই উপায় ছিল না। এই খাদ্যের অভাবের সাথে ছিল ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, কলেরা, প্লেগের মতো কিছু ভয়াবহ রোগ। 


এদিকে প্রেসিডেন্ট মাওজেদং চীনের মানুষদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি চীনে কমিউনিস্ট শাসন নিয়ে এলে চীন অনেক উন্নত একটি দেশ হবে‌। সেই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল ব্রিটেন এবং দ্বিতীয় নম্বরে ছিল আমেরিকা। মাওজেদং ঠিক করেন তিনি চীনের এত উন্নত করবেন, যাতে তিনি আমেরিকাকে পেছনে ফেলে দিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনকে বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ বানাতে পারেন। এই কারণে মাওজেদং চীনে গ্রেট লিভ ফরওয়ার্ড নামে একটা পরিকল্পনা নিয়ে আসেন, যার অর্থ ভবিষ্যতের দিকে এক বড় লাফ। তিনি দেশের সব মানুষদের বলেন, তারা যেন নিজেদের বাড়িতে ছোট ছোট ভাটি বানিয়ে তাতে স্টিল এবং লোহা তৈরি করে। এতে চীন অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে যাবে আর সব কৃষকদের বলা হয় প্রচুর পরিমাণে চাষাবাদ করতে, যাতে দেশের সঠিক খাদ্যের যোগান দেওয়া যায়, আর দেশের বাইরেও সেই ফসল বিক্রি করা যায়। 


তবে মাওজেদং-এর সামনে আরও একটা বড় সমস্যা ছিল চীনের বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব; কলেরা, ম্যালেরিয়া,ডেঙ্গু আর প্লেগের কারণে প্রতি বছর চীনে প্রচুর মানুষ মারা যেত। আর এই রোগগুলো ছড়ায় মশা, মাছির মত পতঙ্গরা। তখন মাওজেদং ঠিক করেন একটি ফোর পেস্ট ক্যাম্পেইন নামে অভিযান চালাবেন আর এটাই হতে চলেছিল পৃথিবীর সবথেকে বড় ভুল। এই ক্যাম্পেনে মোট চারটি জীবকে টার্গেট করা হয়; মশা, মাছি, ইঁদুর এবং চড়ুই পাখি। মাওজেদং দেশের প্রতিটা মানুষকে বলেন এই চারটি জীবকে যেখানে দেখতে পাবে, সেখানেই মেরে ফেলতে। এতে দেশে রোগের পরিমাণ কমবে এবং দেশে অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে যাবে।


এবার মশা ও মাছি মারার কারণ এই দুটি পতঙ্গের জন্য ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া আর কলেরার মতো রোগ হয়। ইঁদুরের কারণে প্লেগ হয়। এবার নিশ্চয়ই আপনি ভাবছেন এখানে চড়ুই পাখি মারার কথা কেন বলা হয়েছে? চড়ুই পাখি তো কোনও রোগ ছড়ায় না। আসলে সেই সময় চীনের প্রেসিডেন্ট মাওজেদং কোনও আইডিয়া ভালো লাগলছ তিনি বেশি বিচার না করেই সেই নিয়ম দেশে চালু করে দিতেন। সেই সময় সরকারের কাছে একটি ইনফরমেশন আসে যে, একটা চড়ুই পাখি এক বছরে প্রায় সাড়ে চার কেজি ফসল খেয়ে ফেলে। সেই হিসাবে গণনা করে দেখেন যে, চীনের না জানি কত কোটি কোটি চড়ুই পাখি রয়েছে, যারা প্রতিবছর সাড়ে চার কেজি হিসেবে কত টন-টন ফসল খেয়ে ফেলে আর এইসব চড়ুই পাখিকে যদি মেরে ফেলা যায়‌, তাহলে বিপুল পরিমাণ ফসল বাঁচানো যাবে আর দেশের অর্থনৈতিক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা এই বেঁচে যাওয়া ফসল বাইরের দেশে বিক্রি করতে পারবে।


এই কারণে মাওজেদং বলেন, 'আমাদের দেশ ওই চারটি জীব ছাড়াও খুব ভালোভাবেই চলবে।' আর এখান থেকে শুরু হয় ওই চার প্রজাতির জীবকে মেরে ফেলার অভিযান, যা ধীরে ধীরে এই প্রজাতির জীবের প্রতি চীনের মানুষদের যুদ্ধের রূপ নেয়। যাতে পাঁচ বছরের ছোট ছোট শিশু থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর লোকজনও যুক্ত হয়েছিল। তবে লোকজন মশা, মাছি আর ইঁদুর মেরে অতটা মজা পাচ্ছিল না, যতটা মজা তারা চড়ুই পাখি মেরে পাচ্ছিল। কারণ চড়ুই পাখি সহজেই দেখা যেত। এরা ইঁদুর বা মশা-মাছির মতো লুকিয়ে থাকতে পারতো না। তারা চড়ুই পাখি মারার জন্য নতুন নতুন সব পদ্ধতি বেছে নেয়, যার মধ্যে একটা ছিল যে চীনের লোকজন ঢাকঢোল, থালা-বাসন বাজিয়ে ওই ছোট নিরীহ প্রাণীদের পিছু করতো। থালা-বাসনের আওয়াজে পাখিরা ভয় পেয়ে যেত। তারা নিচে নামতো না আর আকাশে উড়তেই থাকত। ক্রমাগত উড়তে উড়তে যখন ওই পাখিগুলো ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যেত, তখন চীনের লোকজন সেই পাখিগুলোর ওপর হিংস্র শিকারের মত ঝাঁপিয়ে পড়তো আর তাদের মেরে ফেলত। 


ওই পদ্ধতি ছাড়াও ছোট ছোট বাচ্চারা গুলতি দিয়ে, অনেকে বন্দুক দিয়ে একের পর এক চড়ুই পাখি মেরে ফেলছিল। এমনকি তারা আজব ধরণের ফাঁদ পেতেছিল, এই পাখিদের মারার জন্য। তারা এই পাখিদের বাসা ভেঙে দেয়, তাদের ডিম ফাটিয়ে দেয়, তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের মেরে ফেলে, যাতে এই পাখিরা বংশবিস্তার করতে না পারে। স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষেরা, শহর থেকে গ্রাম, সাধারণ মানুষ হোক বা সেনাবাহিনীর লোকেরা সবাই চড়ুই শিকার করতে থাকে। এমনকি সে সময় এমন এমন প্রতিযোগিতা হতো, যেখানে যে ব্যক্তি সব থেকে বেশি পাখি মারবে তাদের পুরষ্কার দেওয়া হত। স্কুলে যে বাচ্চারা সবথেকে বেশি চড়ুই মেরে নিয়ে আসতো, তাদের পুরষ্কার দেওয়া হতো।


চীনের মানুষেরা এতটাই নৃশংস আচরণ করে যে, তারা মৃত চড়ুই পাখিদের মালা বানিয়ে নিজেদের গলায় পড়তে শুরু করে। তাদের নৃশংসতা এতটাই বেশি ছিল যে, এই ফোর পেস্ট ক্যাম্পেনিংয়ের প্রথম দিনই তারা প্রায় দুই লক্ষ চড়ুই পাখি মেরে ফেলেছিল। চীনের লোকজনদের পাখি মারা একটা নেশার মতো ঘিরে ধরে। তারা এই নির্মম কাজে আনন্দ খুঁজে পায়।


১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত, এই এক বছরে তারা প্রায় ১০০ কোটি চড়ুই পাখি মেরে ফেলেছিল। এছাড়া তারা প্রায় ১৫০ কোটি ইঁদুর, ১০ কোটি কেজি পরিমাণে মাছি এবং ১১ কোটি কেজি পরিমাণে মশা মেরেছিল। 


সেই সময়ের একটি ঘটনা; যখন একদল চড়ুই পাখি চীনের লোকজনের হাত থেকে বাঁচার জন্য চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে থাকা পোল্যান্ড অ্যাম্বাসিতে আশ্রয় নিয়েছিল। লোকজন সেই পাখিগুলোকে মারার জন্য অ্যাম্বাসির মধ্যে ঢুকতে চায়। কিন্তু অ্যাম্বাসির লোকজন তাদের বাধা দেয়। তখন চীনারা চারিদিক থেকে সেই অ্যাম্বাসি ঘিরে ধরে আর জোরে জোরে থালা-বাসন বাজাতে শুরু করে। যার আওয়াজে সেই পাখির দলটি আবার আকাশে উড়তে শুরু করে আর তখন তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আগামী দুই বছরের মধ্যে চীনে চড়ুই পাখি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। 


কিন্তু চীনের মানুষদের পাখি মারার একটা নেশা লেগে যায়। এবার তারা অন্যান্য পাখিদেরও মারতে শুরু করে, আর এতে চীনের সকল প্রকার পাখির পরিমাণ অনেক কমে যায়‌। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ফলে মাওজেদং- এর ফোর বেসড ক্যাম্পিং তো সফল হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়ার ফল এবার চীনের মানুষরা ভোগ করতে শুরু করে।


আপনারা অনেকেই ফুড চেইনের বিষয় জানেন। ফুড চেইনের হিসাবে এই প্রকৃতিতে প্রতিটা জীবের গুরুত্ব আছে। যেমন ধরুন ব্যাঙ পোকামাকড় খায়, আবার সাপ ব্যাঙকে খায়, এই সাপটিকেই আবার ঈগল খায়। এই চেইনের মধ্যে যদি কোনও একটা প্রাণীকে আপনি সরিয়ে দেন তাহলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন যদি আপনি প্রকৃতিতে থেকে ঈগলকে সরিয়ে দেন, তাহলে সাপের প্রজাতি অনেক বেড়ে যাবে। আবার যদি পৃথিবী থেকে সব সাপদের মেরে ফেলা হয়, তাহলে ব্যাঙের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এই ফুড চেইনে যখনই বাধা আসবে, তখনই প্রকৃতি ভয়ানক রূপ নেবে।


চীনের মানুষেরা প্রকৃতির নিয়মে বাধা দিয়েছিল। তারা চড়ুই এবং অন্যান্য পাখিদের এত পরিমাণে মেরে ফেলেছিল যে, তারা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনও কেউ এটা ভাবেনি যে, এই পাখিরা ফসলের পাশাপাশি ছোট ছোট কীটপতঙ্গ খায় আর এই সমস্ত কীটপতঙ্গরা ফসল বেশি নষ্ট করে। 


অতিরিক্ত পরিমাণে পাখি মেরে ফেলার কারণে চীনে কীটপতঙ্গের পরিমাণ এক বছরের মধ্যে কয়েক কোটি গুণ বেড়ে যায়, যাদের মধ্যে সবথেকে ভয়ানক ছিল পঙ্গপালের দল। যারা দলবেঁধে আসত আর হাজার একরের জমির ফসল কয়েক নিমিষের মধ্যে নষ্ট করে দিয়ে চলে যেত আর এভাবেই তারা পরবর্তী গ্রামে আক্রমণ করত। চীনের মানুষরা এই ধরণের ভয়ানক পরিস্থিতির কল্পনাও করতে পারেনি।


পঙ্গপালের দল এত পরিমাণ বেড়ে যায় যে, এক বছরের মধ্যে সারা চীনে ফসলের বিরাট ঘাটতি দেখা দেয়। এমনকি কীটনাশকের ব্যবহার করায়ও কোনও রকম লাভ হচ্ছিল না। প্রকৃতির নিয়মে বাধা দেওয়ার ফল এবার চীনের মানুষরা পাচ্ছিল। ক্রমাগত ফসলের অভাবে চীনে খাদ্যের সংকট দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষ লেগে যায় সারা দেশে। এক একটা ফসলের দানার জন্য তারা হাহাকার করতে শুরু করে। এই সময় মানুষেরা গাছের পাতা, শিকড়, এমনকি মাটি খেতে শুরু করে নিজেদের ক্ষিদে মেটানোর জন্য। 


চীনের এই ভয়াবহ রূপ দেখে মাওজেদং বুঝতে পারেন চড়ুই পাখি ফসল খেয়ে যতটা না ক্ষতি করে তার থেকে অনেক বেশি উপকার করে বিভিন্ন পোকামাকড় খেয়ে। তাই তিনি চড়ুই পাখি হত্যার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেন। কিন্তু ততদিনে অনেক বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। চীনে খাদ্যের অভাবে আগামী দু বছরের মধ্যে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তাতে প্রায় চার কোটি মানুষ মারা যায়। তবে চীনের সরকার এই মৃত্যুর সংখ্যা গোপন রেখেছিল আর বিশ্বের কাছে তারা জানিয়েছিল যে চীনে মাত্র দেড় কোটি মানুষ মারা গিয়েছে আর এই মৃত্যুর কারণ তারা দিয়েছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ।


পরবর্তীকালে বেশকিছু গবেষণা হয় এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে। তাতে চীনের সরকারের বলা মৃত্যুর সংখ্যা যে অনেক কম, তা বোঝা যায়। একজন চীনের সাংবাদিক ইয়াং জিসেঙ্গ, তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯৪০ সালে। তিনি এই দুর্ভিক্ষকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি তার টুমস্টোন দ্যা গ্রেট চাইনিজ ফেমান বইতে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং এখানে তিনি মৃত্যুর সংখ্যা তিন থেকে চার কোটি বলেছেন। উল্লেখ্য, চীনের সরকার এই বইটিকে ব্যান করে দিয়েছে‌। এমনকি আজ পর্যন্ত চীনের কোথাও এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নিয়ে আলোচনা করা হয় না। 


আর এইরকম বোকামি চীনের সরকার একবার করেই থামেনি। সত্তরের দশকে যখন মাওজেদং মারা যায়,তখন চীনের সরকার গ্রামের কৃষকদের আয় বাড়ানোর জন্য বন্য পশু-পাখিদের ধরে বাজারে বিক্রি করার পরামর্শ দেয়, যার কারণে ধীরে ধীরে চিনে ভয়াবহ সব রোগের আবির্ভাব হয়। আর এমনই একটা রোগ ছিল করোনা।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad