২৫০ বছরের ঐতিহ্যে মোড়া মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গা পুজো
পূর্ব মেদিনীপুর: পূর্বের সেই জৌলুশ-আড়ম্বর আজ অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিয়ম মেনেই প্রতিপদে ঘট স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গা পুজো। প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দুর্গা পুজো দেখতে আজও ভিড় জমান দূরদূরান্তের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রতিমা দর্শন করতে আসেন ভিন জেলা, ভিন রাজ্যের দর্শনার্থীরাও।
মহিষাদলের রাজ পরিবারের রানি জানকির আমলে আনুমানিক ১৭৭৬ সালে মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গা পুজো শুরু হয়। সেই সময় থেকেই মহিষাদল রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে একচালার প্রতিমা পূজিতা হয়ে আসছেন। রাজত্ব চলে যাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে রাজবাড়ির দুর্গা পুজোর জৌলুস কমলেও নিয়ম-আচারে ছেদ পড়েনি। তাই প্রথা অনুযায়ী মহালয়ার পরদিন অর্থাৎ প্রতিপদের দিন ঘটস্থাপন করে মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গা পুজোর সূচনা হয়।
এ প্রসঙ্গে এই রাজবাড়ির সদস্য হরপ্রসাদ গর্গ বলেন, ‘মহালয়ার পরের দিন রাজবাড়ির দুর্গা মণ্ডপ লাগোয়া অশ্বত্থ গাছের তলায় নটি ঘট ওঠে। ষষ্ঠী থেকে প্রতিদিনই ঘট পুজো হবে। সপ্তমী থেকে মূর্তি পুজো হবে। প্রতিমার একপাশে ঘট, অন্যপাশে ধান রাখা হয়। এই দুর্গা পুজো করার পরই শুষ্ক গ্রামে ধান ফলেছিল। তাই ভালো ফসলের আশায় আজও দেবীর পাশে ধান রাখা হয়। পুজোয় ১০৮টি নীল পদ্ম দেওয়ার চলও রয়েছে, তাও আগে আসতো উত্তর প্রদেশ থেকে, কিন্তু এখন তা আর হয় না, সাদা পদ্মেই মায়ের পুজো হয়। আগে মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গা পুজোয় যাত্রাপালা, ভোগ বিতরণ, কামান দেগে সন্ধিপুজো, বিসর্জনের শোভাযাত্রা সবই হত।'
হরপ্রসাদ বাবু জানিয়েছেন, পুজোর দিনগুলিতে ঠাকুরদালানেই যাত্রা হত। রাজবাড়ির মহিলারা পর্দার আড়াল থেকে যাত্রা দেখতেন। পুজোর দিন অনুযায়ী ভোগ রান্না হত। যেমন, ষষ্ঠীতে ছয় মন, সপ্তমীতে সাত মন, অষ্টমীতে আট মন, নবমীতে নয় মন চালের প্রসাদ তৈরি করে বিতরণ করা হত। তবে, এখন তা আর সম্ভব হয় না। অষ্টমীর সন্ধ্যায় কামান দেগে রাজবাড়ি সহ আশপাশের এলাকার পুজো মণ্ডপে সন্ধিপুজো শুরু হত। দশমীতে বড় নৌকায় করে শোভাযাত্রা বেরোত এবং রাজবাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া হিজলি টাইডাল ক্যানেল হয়ে গেঁওখালিতে রূপনারায়ণ নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হত। এখন সেই সবই অতীত। রাজত্ব ঘোচার সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রাপালা বন্ধ হয়েছে। পুজোর দিনগুলিতে অবশ্য এখনও ভোগ রান্না করা হয়। কিন্তু তা যৎসামান্য।
এদিকে সরকার কামান দাগায় নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সেটাও ইতিহাসের পাতায় চলে গিয়েছে। এখন কামান দাগার পরিবর্তে আতসবাজির রোশনাইয়ের মধ্যে দিয়ে সন্ধি-পুজো করা হয়। বিসর্জনের শোভাযাত্রাও অতীত। রাজবাড়ি লাগোয়া রাজদীঘিতেই প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। তবে আড়ম্বর কমলেও ঐতিহ্যের টানে আজও বহু মানুষ মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গা পুজোয় সামিল হন। দর্শনার্থীদের যাতে কোনও রকম অসুবিধে না হয়, সেজন্য বর্তমান রাজ পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি নজরে রেখেছেন। পুজোয় আগত দর্শনার্থী বা পর্যটকদের পরিষেবা দিতে রাত্রী যাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে মূল্য দিয়ে থাকতে হবে।
মহিষাদল রাজবাড়ির বর্তমান প্রজন্ম হিসাবে রাজবাড়ি দেখাশোনা করে থাকে শঙ্কর প্রসাদ গর্গ ও হর প্রসাদ গর্গ। রাজবাড়ির পুজো দেখতে এবং রাজবাড়ির অপরূপ পরিবেশের মজা নিতে আসতেই হবে মহিষাদলে।
No comments:
Post a Comment