বাংলার অসহায়দের ত্রাতা বাংলার ব্যতিক্রমী এই মাস্টারমশাই - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Wednesday 21 February 2024

বাংলার অসহায়দের ত্রাতা বাংলার ব্যতিক্রমী এই মাস্টারমশাই

 


বাংলার অসহায়দের ত্রাতা বাংলার ব্যতিক্রমী এই মাস্টারমশাই



কলকাতা: ১২০০ জন দুঃস্থ ছেলেমেয়েকে বিনামূল্যে পড়াশোনা শিখিয়ে, ভরপেট খাইয়ে মানুষের মত মানুষ তৈরি করছেন বাংলার এই শিক্ষক চন্দ্রশেখর কুণ্ড, লড়াইয়ের আর এক নাম। ঘটনার সূত্রপাত আট বছর আগে। সেই দিন ছিল চন্দ্রশেখর বাবুর ছেলের জন্মদিন। ঐদিন রাতেই চন্দ্রশেখর বাবু এটিএমএ টাকা তুলতে গিয়ে দেখেন ডাস্টবিনের সামনে বাতিল খাবারের আস্থাকুর থেকে বিরিয়ানি তুলে খাচ্ছে একটি বাচ্চা মেয়ে ও তার ভাই। এই যন্ত্রণাময় দৃশ্য দেখে সেদিন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন আসানসোলের একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষক চন্দ্রশেখর কুণ্ডু। সেদিন রাতে ওই দুঃস্থ বাচ্চাদুটিকে নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন তিনি। স্ত্রীকে বলেছিলেন ওদের খেতে দিতে।


সেদিন বাচ্চা দুটো চলে যাওয়ার পর, সারারাত ঘুমোতে পারেননি তিনি। একজন বাবা হয়ে নিজের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নিজের সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে এই দুঃস্থ বাচ্চাগুলোকে তিনি কখনো না খেয়ে ঘুমাতে দেবেন না। আসুন আজ এমন এক বাঙালি ভদ্রলোকের গল্প জানা যাক, যিনি বাবা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন শ'য়ে শ'য়ে দুঃস্থ অনাথ, অবহেলিত বাচ্চাদের।


২০১৬ সালের রাস্তার ডাস্টবিন থেকে বাচ্চাদের খাবার খেতে তুলে দেখার পরেই জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল ৪৭ বছরের এই শিক্ষকের। সর্বোপরি একজন বাবার। চন্দ্রশেখর বাবু রিসার্চ করে দেখেন আমাদের ভারতবর্ষে প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোকের ভরপেট খাবার জোটে না। ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে সংখ্যাটা আরও বেশি। চন্দ্রশেখর বাবু এরপর অনুষ্ঠান বাড়ির বাড়তি খাবার নিয়ে স্টেশনের দুঃস্থ মানুষদের থেকে শুরু করে এলাকার সমস্ত দরিদ্র মানুষদের খাওয়াতে শুরু করলে। ধীরে ধীরে কিছু বেসরকারি কোম্পানির ক্যান্টিনের সঙ্গেও টাইআপ করেন। তারপর তাদের থেকে খাবার সংগ্রহ করে ছুটে যান আসানসোল ও কলকাতার দুঃস্থ বাচ্চাদের কাছে। 


এরপর ২০১৬ সালে চন্দ্রশেখরবাবু তৈরি করেন তাঁর এনজিও "ফিড"। চন্দ্রশেখর বাবু বুঝতে পারেন, বাচ্চাগুলোর দু'বেলার খাবার জুটলেই সমস্যা সমাধান হবে না, এদের দরকার শিক্ষার। আর তাই বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর পাশাপাশি, তাদের ফ্রিতে কোচিং ক্লাসেরও ব্যবস্থা করেন তিনি। 


চন্দ্রশেখর বাবুর মতে, গ্রামের দিকে বাচ্চাদের প্রধান সমস্যা স্কুল ড্রপ। এরা গরীব ঘর থেকে উঠে আসার দরুন পড়াশুনার জন্য আলাদা করে কোনও গাইডেন্স পায় না। খুব অল্প দিনের মধ্যেই তারা স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যাদের শুধুমাত্র মিড ডে মিল দিয়ে স্কুলমুখি করা সম্ভব নয়। আর তাই আসানসোল, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান মিলিয়ে মোট ১৬ টা কোচিং সেন্টার চালান চন্দ্রশেখর বাবু। এই প্রতিটা কোচিনের স্পনসর করেন আলাদা আলাদা ১৬ জন মানুষ।


সেল আইএসপি এবং কলকাতার আদিত্য একাডেমির সহায়তায় আসানসোলের চক্কা যৌনপল্লী, ব্লু ফ্যাক্টরি ভূইয়া পাড়া, পলাশডিয়া ভূইয়া পাড়া, নয়াবস্তির মত এলাকায় গরীব বাচ্চাদের পড়াশুনা শেখানোর পাশাপাশি রোজ রাতে খাবারের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে চন্দ্রশেখর বাবুর এনজিও "ফীড"। এইসব এলাকাতে মায়েদের জন্যঝ পাঠশালা বসে। যেখানে ৬২ জন মা পড়াশোনা করেন। কারণ চন্দ্রশেখর বাবু মনে করেন, একজন মা যদি পড়াশোনা না জানে, তাহলে একজন বাচ্চাকেও শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব নয়।


এছাড়াও আসানসোলের মত জায়গায় ২০০ জন দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের নিয়ে তৈরি করেছেন একটি ক্যাম্পাস, যে ক্যাম্পাসের নাম স্বামী বিবেকানন্দ ক্যাম্পাস। যেখানে দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের জন্য রয়েছেন লাইব্রেরি। তাদের এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি শেখানোর পাশাপাশি রয়েছে ক্যারাটেতেও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা। রয়েছে স্মার্ট ক্লাস, রোবোটিক ক্লাস। এমনকি সমাজে পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের নিয়ে চন্দ্রশেখর বাবু তৈরি করেছেন একটা গোটা ফুটবল টিমও। 


আজ চন্দ্রশেখর বাবু মোট ১২০০ বাচ্চার অভিভাবক। একদিন যে বাচ্চাগুলি খেতে না পেয়ে ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খেত, আজ চন্দ্রশেখর বাবুর জন্যই তারা ভরপেট খেতে পায়। শুধু তাই নয়, তারা যাতে পড়াশোনা শিখে সমাজের বুকে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন তিনি। তাই চন্দ্রশেখর বাবুর এই মহান উদ্যোগে এগিয়ে এসেছেন বহুসহৃদয় ব্যক্তি। 


চন্দ্রশেখর বাবুর সংসার বলতে বাবা, মা, স্ত্রী ও এক সন্তান। তারাও চন্দ্রশেখর বাবুর এই মহৎ কাজে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। শেখর বাবু বলেন, একদিন তিনি থাকবেন না কিন্তু সমাজকে প্রতিটি শিশুর বাসযোগ্য করে যাবেন। এটাই তার এক মাত্র লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য বুকে নিয়ে বিগত আটটা বছর ধরে নিঃস্বার্থভাবে লড়ে যাচ্ছেন বাংলার এই মানুষটা। আমাদের পক্ষ থেকে এই মানুষটিকে জানাই কুর্নিশ।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad