নবাবদের মুদ্রা ধার দিতেন জগৎ শেঠ, শেষ পরিণতি কী হয়েছিল জানেন?
কলকাতা: জগৎ শেঠের বিরুদ্ধে গিয়েই কি সেই ভয়ঙ্কর পরিণতি হয়েছিল বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার? একই পরিণতি কিন্তু বাংলার দ্বিতীয় নবাবের সাথেও হয়েছিল। মুঘল আমলে নবাব দেশ টাকা ধার দিতেন জগৎ শেঠ। বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁয়ের খুবই খাসনবিশ ছিলেন। টাকার জোরে নাকি গঙ্গার বুকে বাদ দিয়ে গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাহলে কি বাংলার দ্বিতীয় নবাব সরফরোজ খান ও শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা এই জগৎ শেঠের বিরুদ্ধে গিয়েই বাংলার সিংহাসন চ্যুত হয়েছিলেন?
ইতিহাসের পাতায় সেই পলাশীর যুদ্ধ নিশ্চয়ই শুনেছেন। কিন্তু এই জগৎ শেঠের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল জানেন? তা ছিল খুবই যন্ত্রণাদায়ক। সিরাজের পরবর্তী নবাড় মীর কাশীম জগৎ শেঠকে হাত-পা বেধে দুর্গের উপর থেকে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। যার গঙ্গা নদীর বুকে বাঁধ দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, সেই গঙ্গার জলে ডুবে মরতে হল জগৎ শেঠদের। আজও মুর্শিদাবাদের মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর সেই রহস্যে ঘেরা বাংলো। আজকের এই প্রতিবেদনে জেনে নিন মুর্শিদকুলি খাঁয়ের আমলে জগৎ শেঠের উত্থান ও মীর কাশীমের হাতে তাদের সেই পতনের রহস্যময় কাহিনী।
প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় আনুমানিক কয়েকশো বছর আগের ঘটনা। রাজস্থানের হিরানন্দ সাউ নামে খুবই দরিদ্র এক ব্যক্তি একদিন ঘুরতে ঘুরতে পাটনায় এসে হাজির হন। খাদ্যের সন্ধানে এক জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই সেই জঙ্গলে দেখতে পান একটি বিশাল আকারের বাংলো। সেই বাংলোর ভেতর থেকেই নাকি গুপ্তধন পেয়েছিলেন হীরানন্দ সাউ মূলত সেই সম্পত্তি থেকেই জগৎ শেঠের উত্থান। সেই সময় বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। সেখানে এসে প্রথম বসবাস শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে রাজা-জমিদারদের টাকা ধার দিতে থাকেন হীরানন্দ।
এরই মধ্যে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হয়ে আসেন মুর্শিদকুলি খাঁ। তিনি ঢাকা থেকে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। সেই সময় মুর্শিদকুলির সাথে পরিচয় হয় হিরানন্দ সাউয়ের। হিরানন্দও ঢাকা ছেড়ে তাঁর ব্যবসা নিয়ে চলে আসেন মুর্শিদাবাদে। কিছু দিন পর মৃত্যু হয় হিরানন্দর। তারপর শেঠ বংশের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে তার কনিষ্ঠ পুত্র মানিকচাঁদের ওপর। আর এই মানিকচাঁদের কাছ থেকেই নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ টাকা ধার নিয়ে সাম্রাজ্য চালাতেন।
মুর্শিদকুলি খাঁ-ই প্রথম দিল্লী থেকে জগৎ শেঠ উপাধি নিয়ে এসেছিলেন মানিকচাঁদের জন্য। তারপর থেকেই জগৎ শেঠের উত্থান। এদিকে মানিকচাঁদের মৃত্যুর পর জগৎ শেঠ উপাধি পায় তার দত্তক পুত্র ফতেচাঁদ। অন্যদিকে তখন মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর নবাবের সিংহাসনে বসেন তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন। তবে সুজাউদ্দিনের সাথে জগৎ শেঠের সুসম্পর্ক থাকলেও পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিনের ছেলে সারফারাজের সাথে মতবিরোধ হতে থাকে জগৎ শেঠের।
সেই সময় জগৎ শেঠ ফতেচাঁদ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বিহারের নবাব আলীবর্দী খানের সাথে পরামর্শ করে সরফরাজকে সরিয়ে আলীবর্দীকেই বাংলার সিংহাসনে বসতে সাহায্য করে। সরফরাজের শেষ পরিণতি হয় খুবই ভয়ংকর। কিন্তু আলীবর্দী খানের পর যখন বাংলার নবাব হন সিরাজদ্দৌলা, তারপর থেকেই খারাপ সময় আসতে থাকে জগৎ শেঠদের।
সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন অস্থির অত্যাচারিত ও বিশৃঙ্খলা জীবন যাপনের মানুষ। জগৎ শেঠের পরিবারকেও বিভিন্ন সময় হেনস্থা করতেন সিরাজদ্দৌলা। এরপর থেকে শুরু হয় চক্রান্ত পাল্টা চক্রান্ত। জগৎ শেঠ নিজের ব্যবসা ও পরিবারের সম্মান বাঁচাতে সিরাজের সেনাপতি মীরজাফরের সাথে এক হয়ে ইংরেজদের কাজে লাগিয়ে সিরাজদ্দৌলাকে ভয়ংকর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। শেষ জীবনে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় সিরাজদ্দৌলাকে। আর বাংলার এই শেষ স্বাধীন নবাবের মৃত্যুর পর থেকেই ধীরে ধীরে ইংরেজদের প্রভাব পড়তে থাকে গোটা ভারত জুড়ে।
ইংরেজদের সাথে শর্ত মেনে বাংলার সিংহাসনে বসে মীরজাফর। ততদিনে জগৎ শেঠ বুঝতে পারে ইংরেজদের আসল মতলব । কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। জগৎ শেঠ চাইলেই পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের হারিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু সিরাজদের সিংহাসন চ্যুত করতে গিয়ে সে যেই ইংরেজদের হাত ধরেছিল, সেই ইংরেজদের ষড়যন্ত্রেই আজ কোনও সম্পত্তি নেই জগৎ শেঠের উত্তরসূরীদের। তাদের বিপুল পরিমাণ সেই সম্পত্তি সম্পূর্ণই লুট করেছে ইংরেজরা।
অন্যদিকে মীরজাফরের পরবর্তী নবাব মীরকাসেমও বদলা নেওয়ার জন্য তৈরি ছিল। ইংরেজদের একের পর এক হামলায় পরাজিত হয়ে শেঠ বংশের দুই উত্তরসূরি মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদকে বন্দী করে নিয়ে যায় মীর কাসেমের দুর্গের একদম ওপরে। সেখান থেকেই নিক্ষেপ করা হয় গঙ্গার বুকে। এভাবেই বাংলা থেকে ধ্বংস হয়ে যায় ধন কুবেরের শেঠ বংশ। আর সেই ধনসম্পত্তি গিয়ে পড়ে ইংরেজদের হাতে।
No comments:
Post a Comment