যশস্বী ভাঙলেন ১৪৭ বছরের ঐতিহাসিক রেকর্ড
প্রদীপ ভট্টাচার্য, ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, কলকাতা: যশস্বী জয়সওয়াল, তিন ম্যাচে দুটো ডাবল সেঞ্চুরি করে ২২ বছর বয়সী ছেলেটা ভেঙে ফেলল ১৪৭ বছরের রেকর্ড। যশস্বীর আগে কেউ একটা টেস্ট সিরিজে ২২ খানা ছক্কা মারেনি। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত বোলার জিমি অ্যান্ডারসনকে পরপর তিন বলে তিনটে ছয় মেরে যশস্বী যেন বুঝিয়ে দিল আমি যশস্বী, এবার থেকে আমার রাজত্ব শুরু হল।
যশস্বীর বাবা ভূপেন্দ্র জয়সওয়ালের একটা ছোটো হার্ডওয়্যারের দোকান রয়েছে। যশস্বীরা মোট ছয় ভাই বোন। ওই ছোট্ট দোকানের উপার্জন থেকেই আটজনের মুখের ভাত উঠত। এমন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর ঘরে যশস্বীকে একটা ব্যাট বা হেলমেট কিনে দেবার ক্ষমতা ছিল না ভূপেন্দ্র জয়সওয়ালের। ছোট্ট যশস্বী শুনেছিল মুম্বাইতে নাকি ভালো ক্রিকেট খেলার সুযোগ রয়েছে। সচিন তেন্ডুলকার থেকে রোহিত শর্মা সবাই উঠে এসেছেন মুম্বাইয়ের মাটি থেকে। তাই বয়স যখন মাত্র দশ, তখন উত্তরপ্রদেশের ঘরবাড়ি ছেড়ে যশস্বী পাড়ি দিলেন মুম্বাইয়ে। প্রথমে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গাদাগাদি করে কিছুদিন কাটলো। কিন্তু কয়েকদিন বাদে সেই আত্মীয় বাড়িতে জায়গার অভাব বলে আর থাকতে দিল না যশস্বীকে। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর গোয়ালার সঙ্গে চুক্তি হলো যশস্বীর। শর্ত অনুযায়ী গোয়াল ঘরে রাত কাটানোর বিনিময়ে ভোর চারটেই উঠে গোয়ালাকে কাজে সাহায্য করতে হবে। গোবরের গন্ধ, মশার কামড়, আধপেটা খাওয়া, হাসিমুখে সবটা মেনে নিয়েছিল ছোট্ট যশস্বী। শুধু ক্রিকেট প্র্যাকটিস ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাবে না বলে। কিন্তু কদিন বাদেই সেই গোয়ালাও তাড়িয়ে দিল যশস্বীকে। কারণ হিসেবে জানালো ক্রিকেট প্র্যাকটিস করার তাড়াহুড়োয় যশস্বী ঠিকভাবে কাজ করছে না। আবার শুরু হলো মাথার ওপর ছাদ খোঁজার লড়াই। নিজের একমাত্র আস্তানা হারিয়ে ময়দানের একটা ছোট্ট তাঁবুর মধ্যেই রাত কাটতে থাকলো যশস্বীর। কিন্তু জীবনে যতই হতাশা, কষ্ট, যন্ত্রণা থাকুক ব্যাট হাতে মাঠে নামলেই যেন যশস্বীর উপর ভর করত ক্রিকেট দেবতা। নিজের থেকে বয়সে বড় ছেলেদের বলে ৪ ও ৬ এর বন্যা বইয়ে দিত ছোট্ট যশস্বী। এই ভাবেই একদিন কোচ জ্বালা সিংয়ের চোখে পড়ে যান যশস্বী। জ্বালা সিং বুঝতে পারেন ছোট্ট ছেলেটির মধ্যে মাঠের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটানোর সমস্ত রকম গোলাবারুদ মজুত আছে। তাই যশস্বীকে তিনি নিজের বাড়িতে ঠাঁই দেন। খাওয়া পড়ার চিন্তা দূর হতেই আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন যশস্বী।
গত আইপিএলে যশস্বী যখন একটার পর একটা ম্যাচে সেঞ্চুরি ও হাফসেঞ্চুরির ফোয়ারা ছোটাচ্ছিল তখন অনেকেই বলেছিল, এসব ফাটকা প্লেয়ার দুদিনের জন্য ওঠে আবার পড়েও যায়। কিন্তু যশস্বী যে ফাটকা প্লেয়ার নয়, তা দেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামতেই সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখনো একটাও ওয়ানডে খেলেননি যশস্বী। তবে দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি খেলতে নেবেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। বিদেশের মাটিতে জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই ১৭১ রানের ইনিংস খেলে চমকে দিয়েছেন সকলকে। আর এবার পালা ছিল ইংল্যান্ডের। দুরমুস করা কাকে বলে জানেন নিশ্চয়ই! যশস্বী নিজের ব্যাট দিয়ে ঠিক সেইভাবেই দূরমুস করে দিল ইংল্যান্ডের বোলারদের। অ্যান্ডারসনকে পরপর তিন বলে তিনটে ছয় মেরে ইংল্যান্ডের সকলের মনোবলকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন যশস্বী। আর তারই ফলাফল টিম ইন্ডিয়ার ৪৩৪ রানের ঐতিহাসিক টেস্ট জয়। ময়দানের তাঁবুতে রাত কাটানো ছেলেটা আজ সুপারস্টার। গোয়াল ঘরে গোবরের গন্ধে ঘুমোতে না পারা ছেলেটাকে সমীহ করছে সারা ইংল্যান্ড। মাত্র ১০ বছর বয়সে ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসা ছেলেটা আজ দেশ বিদেশের সমস্ত মিডিয়ার আলোচনার বিষয়বস্তু। এটাকে যদি রূপকথা না বলা হয় তাহলে রূপকথা কোনটা? এটা যদি রিয়েল মোটিভেশন না হয়, তাহলে রিয়েল মোটিভেশন কোনটা? যশস্বী জয়সওয়াল, বিরাট কোহলির পর বিশ্ব ক্রিকেটের আগামী দিনের কিং। কথাটা মিলিয়ে নেবেন।
No comments:
Post a Comment