দুটো ছাতিম গাছ ছাড়া ছিল না কিছুই! বিশ্ব হেরিটেজ তকমা পেল সেই শান্তিনিকেতন!
প্রদীপ ভট্টাচার্য, ২২ শে ফেব্রুয়ারি, কলকাতা: শান্তিনিকেতন, বাংলার বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের একটি পাড়া। কিন্তু এই পাড়ায় একটা সময় দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আর দুটো ছাতিম গাছ ছাড়া আর কিছু ছিল না। আজ্ঞে হ্যাঁ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়ার সময় ভুবনডাঙ্গা নামের এক গ্রামের কাছে এক বিশাল মাঠের ভেতর দুটো ছাতিম গাছ দেখে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এরপর সেই ছাতিম গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই জায়গাটা এতটাই ভালো লেগেছিল যে, তৎকালীন রায়পুরের জমিদার ভুবন মোহন সিংহের কাছ থেকে দুটি ছাতিম গাছ সহ কুড়ি একর জমি বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় কিনে একটি গেস্ট হাউস তৈরি করেছিলেন।যার নাম দিয়েছিলেন 'শান্তিনিকেতন', অর্থাৎ শান্তির স্থান।
আসুন আজকে আমরা জেনে নিই বাংলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতন সম্পর্কে। যে শান্তিনিকেতনের নাম আজ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকায় জ্বলজ্বল করছে। শান্তিনিকেতনের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিস্তীর্ণ লাল মাটির খোয়াই, কোপাই নদীর কোল ঘেঁসে শাল ও মন উদাস করা বাউল গান। আর আকাশমনির ঘন জঙ্গল। তাই শান্তিনিকেতনের লাল মাটির রাস্তায় শীত শেষের এই শিরশিরে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনিও কবিগুরুর ভাষায় বলে উঠবেন, আমাদের শান্তিনিকেতন, আমাদের সব হতে আপন।
কলকাতা শহর থেকে দূরে বীরভূম জেলার বোলপুর শান্তিনিকেতনের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকেছিলেন তিনি। পৃথিবীর কোথাও গিয়ে দুদন্ড শান্তি পেতেন না কবি। যেখানে যেতেন উতলা হয়ে উঠতেন শান্তি নিকেতনে ফেরার জন্য। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন কবিগুরু। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের সমগ্র এলাকাটিকে একটি ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম চালু করেছিলেন। বর্তমানে যার নাম পাঠভবন। আপনি যদি শান্তিনিকেতনে যান তাহলে অবশ্যই ঘুরে দেখে আসবেন শান্তিনিকেতন ভবন। এটি এই আশ্রমের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। এই বাড়িতেই কবিগুরু তার বাবার সঙ্গে হিমালয় যাবার পথে এবং পাঠভবন তৈরি করার সময় বেশ কিছুদিন ছিলেন। বর্তমানে এই বাড়ীর সামনে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ নির্মিত একটি বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে। এছাড়াও ঘুরে দেখবেন উপাসনা মন্দির, ছাতিমতলা। ছাতিম তলায় গিয়ে দাঁড়ালে আপনিও অনুভব করবেন প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ এবং আত্মার শান্তি। এছাড়াও দেখে আসবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের হাতে গড়ে তোলা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। যাকে শান্তিনিকেতনের প্রাণকেন্দ্র বলা যায়। এছাড়াও দেখতে ভুলবেন না উপাসনা গৃহ, তালধ্বজ, কলাভবন, রবীন্দ্র ভবন, পৌষমেলার মাঠ, তিনপাহাড়, নতুন বাড়ি, শালবিথি, আম্রকুঞ্জ, উত্তরায়ণ প্রাঙ্গন, বকুল বিথি। এবং অবশ্যই দেখে আসবেন বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে কোপাই নদীর ভিউ পয়েন্ট।
শান্তিনিকেতনের অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আরেকটি হলো সোনাঝুরির হাট। হপ্তাশেষে দুদিন করে বসে এই হাট, যার সৌন্দর্য দেখলে আপনারও চোখ জুড়িয়ে যাবে। সোনাঝুরির এই হাটে গেলে পাবেন গ্রামের শিল্পীদের নিজের হাতে বানানো নানা ধরনের কারু কাজ। হাতে বাঁধানো গয়না থেকে শুরু করে ব্যাগ, খেশ শাড়ি, কাঠের তৈরি নানান ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, কাঠের আসবাব এবং আরও অনেক কিছু। আর তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা বাউল গান আর সঙ্গে মাদলের তালে আদিবাসী নৃত্য। এছাড়াও দেখতে ভুলবেন না গীতাঞ্জলি রেল মিউজিয়াম, কঙ্কালিতলা, বিশ্ববাংলা হাট, বল্লভপুর ডিয়ার পার্ক, বিশ্বভারতী মিউজিয়াম, আমার কুটির এবং খোয়াই বনের হাটের মতো জায়গাগুলি।
শান্তিনিকেতনের সারা বছর বিভিন্ন উৎসব লেগেই থাকে। এখানকার বিখ্যাত উৎসব বসন্ত উৎসব। এই উৎসবের সময় শান্তিনিকেতনের শোভা যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তাই আজও এই বসন্ত উৎসব দেখার জন্য অসংখ্য মানুষ ছুটে যান শান্তিনিকেতনে। এই সময় রং আর আবিরের ছোঁয়ায় যেন প্রকৃতিও সেজে ওঠে নতুন করে। এ যেন এক আলাদা শোভা যা চাক্ষুষ না দেখলে শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই সামনের কোনও এক উইকেন্ডে ঘুরে আসুন কবিগুরুর এই মাতৃক্রোড়।
No comments:
Post a Comment