মোটা চেহারা, ছেলেদের মতো গোঁফ! এই রাজকুমারীর প্রেমে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৭জন
প্রদীপ ভট্টাচার্য, ৩রা মার্চ, কলকাতা: ছবিতে দেখা এই মেয়েটির জন্য পাগল ছিল গোটা দেশের যুবকরা। তিনি প্রতিদিন শত শত লাভ লেটার পেতেন। এমনকি তার প্রেমে পাগল হয়ে তাকে না পেয়ে ১৩ জন ছেলে দুঃখে তাদের নিজেদের জীবন দিয়ে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন! এই ভারী চেহারার পারসিয়ান রানীকে সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রানী বলা হতো। একটা মেয়ে যার ওজন প্রায় ১০০ কেজিরও বেশি । চওড়া ভুরু এমনকি মুখে ছেলেদের মত গোঁফও ছিল। তা সত্বেও তৎকালীন সময় তাকে পারস্যের সবচেয়ে সুন্দরী নারী বলা হতো। আপনারা অনেকেই আগে হয়তো এই রাজকুমারীর ছবি দেখে থাকবেন। অনেকে তো আবার এই ছবিতে কোনও বন্ধুকে ট্যাগ ক'রে মজাও করেন। বলে এটা তোর ফিউচার ওয়াইফ। কিন্তু আজকের সমাজে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে রাজকুমারীর রূপ চেহারা নিয়ে হাসাহাসি করা হয়, তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে সুন্দরী নারী। এখন নিশ্চয়ই আপনার মনে হচ্ছে এই নারীর মধ্যে এমন কি ছিল যে তাকে না পেয়ে এতগুলো ছেলে নিজেদের জীবন দিয়ে দিয়েছিল! আর কেন তাকে তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে সুন্দরী নারী বলা হতো?
কেন এই নারী বহু নামকরা রাজা মহারাজাদের প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন?
২০১৭ সালে প্রথমবার গোঁফওয়ালা এক মেয়ের ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়। সেখানে তার নাম বলা হয় প্রিন্সেস কাজার। তবে আপনাদেরকে জানিয়ে দিই, এই রাজকুমারীর আসল নাম জাহারা খানুম। আর তার উপাধি ছিল ইসমত উদ দৌল্লা। পারস্যের কাজার বংশের রাজা নাসিরউদ্দিন শাহ কাজার এবং তার স্ত্রী তাজউদ্দৌলার দ্বিতীয় কন্যা ছিলেন প্রিন্সেস কাজার। তার জন্ম হয় ১৮৮৪ সালে। কাজার রাজবংশের কন্যা হওয়ার জন্য তাকে প্রিন্সেস কাজার বলা হতো। নাসিরুদ্দিন শাহ কাজার ছিলেন কাজার রাজবংশের সবচেয়ে যোগ্য এবং সফল শাসক। তার সময় পারস্যে ব্যাপকভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। নাসিরউদ্দিন শাহ তার মেয়ে ইস্মাতকে খুব আদর যত্ন করতেন এবং আধুনিকতার সমস্ত সুযোগ সুবিধার মধ্যে বড় করেছিলেন। ইস্মাতকে সেই সময় সবচেয়ে সুন্দরী নারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আর প্রিন্সেস কাজার স্রোতের বিপরীতে চলতে পছন্দ করতেন। প্রচলিত রীতি রেওয়াজ ভেঙে তিনি পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন। পড়াশোনা শিখেছিলেন এমনকি তিনি ছবি তুলতেও খুব ভালবাসতেন। তার বেশিরভাগ ছবি তুলেছিলেন তার স্বামী দাস্ত মোহম্মদ খান। কাজারের ছবি দেখে আমাদের অনেকেরই মনে হয় মোটা এবং গোঁফওয়ালা একটি মেয়েকে কেউ কিভাবে সুন্দরী বলতে পারে?
এখানে আসল ঘটনা হলো ১৯ শতকের সময় পৃথিবীতে তখনো ওয়েস্টার্ন কালচার ছড়িয়ে পড়েনি। তখন ভারি চেহারার মেয়েদেরকে আকর্ষণীয় মনে করা হতো। এবং মেয়েদের গোঁফ রাখা একটি অদ্ভুত রীতি পারস্যে প্রচলিত ছিল। কাজার বংশের মেয়েদের মুখে হালকা গোঁফ থাকাটাই তাদের সৌন্দর্যের প্রতীক বলে মনে করা হতো। আর এই কারণেই পারস্যের পুরুষরা ইস্মাতের চেহারা এবং তার সৌন্দর্যের প্রেমে পাগল ছিল। এমনকি কাজারকে বিয়ে করতে চেয়ে উপেক্ষিত হওয়া ১৩ জন পুরুষ নিজেদের জীবন ত্যাগ করেছিলেন। তবে শুধুমাত্র রূপ নয় প্রিন্সেস কাজার নামে পরিচিত ইস্মাতকে সেই সময় গুনী এবং প্রভাবশালী বলেও মনে করা হতো। কাজার পেশায় একজন রাইটার ছিলেন।
এবং তার পেন্টিংয়েরও শখ ছিল। শুধু তাই নয়, শুধু তাই নয় কাজার সেই সময় একজন বিখ্যাত নারীবিদও ছিলেন। তিনি মহিলাদের অধিকার নিয়ে বারবার আওয়াজ তুলেছিলেন। মহিলাদের আধুনিক শিক্ষা চাকরি স্বাধীনতা এমনকি সংবিধান সংশোধন করার ব্যাপারেও তিনি আওয়াজ তুলেছিলেন। প্রিন্সেস কাজার পারস্যের প্রথম মহিলা ছিলেন, যিনি মহিলাদের অধিকারের জন্য আওয়াজ তুলেছিলেন। আর এখান থেকেই আন্দাজ করা যায়, তিনি ঠিক কতটা আধুনিক চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। আর এই কারণেই পুরো পৃথিবী এখনো পর্যন্ত কাজারকে কোনও মোটা গোঁফওয়ালা রানী বলে নয় বরং একজন ভালো মানুষ এবং প্রভাবশালী নারী হিসেবে মনে রেখেছে। কাজার প্রমাণ করেছে যে কখনো শরীর, রূপ এবং রং দেখে কাউকে বিচার করা উচিত নয়। প্রত্যেককে তার কাজ দেখে বিচার করা উচিত।
কাজারের ব্যাপারে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা যায় যে, তিনি প্রথম মহিলা যিনি হিজাব ত্যাগ করেছিলেন। এবং প্রথম পার্সিয়ান মহিলা যিনি ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়েছিলেন। কাজারের চিন্তাভাবনা সেই সময়কার মেয়েদের থেকে অনেক বেশি আধুনিক ছিল। আর তার প্রধান কারণ হলো কাজারের শিক্ষা। থেকেই তার পিতা নাসিরুদ্দিন শাহ কাজারকে আধুনিক শিক্ষা এবং আধুনিক চিন্তাধারার মধ্যে বড় করেছিলেন। আর সেই কারণেই কাজার আজও পারস্যের ইতিহাসে এক বড় জায়গা দখল করে আছে। কাজারের জীবন বাইরে থেকে দেখে খুব সুখী বা ফিল্মের নায়িকার মত মনে হলেও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে খুব একটা সুখী ছিলেন না। মাত্র ১০ বছর বয়সে কাজারের বিয়ে হয়ে যায় আর সেখান থেকেই দুঃখের দিন শুরু হয়। প্রথম কয়েক বছর তাদের ভালই কেটেছিল। এবং কয়েক বছরের মধ্যে তাদের চারজন সন্তানও হয়। তাদের দুজন ছেলে ও দুজন মেয়ে ছিল। এখানে জেনে রাখা ভালো যে, উনিশ শতকের সময় ইরানে বহির্ভূত সম্পর্ক বা এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারকে খারাপ চোখে দেখা হতো না। এবং খুব সাধারণ বিষয় হিসেবেই মনে করা হতো। তাই রানী কাজারের সেই সময় অনেকের সাথেই অ্যাফেয়ার ছিল। এমনকি তার স্বামীও অন্য মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন। আসলে রানী তার বিবাহিত জীবনে একদমই সুখী ছিলেন না। এবং এই কারণে তিনি বেশ কয়েকবার নিজের জীবন শেষ করে দেবারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই কোন না কোন কারণে তার সেই চেষ্টা বিফলে যায়। কাজারের প্রথম বিয়ে খুব বেশিদিন টেকেনি। বিয়ে ভেঙে তিনি আবার সমাজসেবায় মন দেন। তিনি বরাবরই সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে ভালোবাসতেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আবার দ্বিতীয় বিবাহ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার দ্বিতীয় বিবাহও খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়। দ্বিতীয় বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর কাজার সিদ্ধান্ত নেন আর কখনো কোন সম্পর্কে জড়াবেন না, সম্পূর্ণ একা থাকবেন। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত তার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন কেউ মেনে নেননি। এমনকি যে সমাজের জন্য কাজার এত কিছু করেছিলেন, সেই সমাজও কাজারকে পতিতা বলে গণ্য করেছিল। সমাজসেবা করার জন্য কাজারকে বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকতে হতো। কিন্তু পরপর দুবার কাজারের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর সমাজের লোকজন কাজারকে খারাপ চোখে দেখতে শুরু করে। যে কাজের জন্য একসময় সবাই কাজারের প্রশংসা করত সেই সমাজসেবার কাজকেও সবাই খারাপ ভাবে দেখতে শুরু করল। তার দিনের পর দিন বাইরে থাকার ব্যাপারটা কেউ আর মেনে নিতে চাইনি। শেষমেষ পরিস্থিতির চাপে অতিষ্ট হয়ে কাজার তৃতীয় বিবাহ করেন। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে কাজারের তৃতীয় বিয়েও ভেঙে যায়। তাকে আবার ফিরে আসতে হয় নিজের বাবার বাড়িতে।
তারপর কাজার আর বিয়ে করেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একা থাকার। যে রানীকে একসময় দাস দাসীতে ঘিরে থাকতো, সেই তিনি তার শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন সম্পূর্ণ একা। আর এই একাকীত্ব সহ্য করে কাজার বেশিদিন বেঁচে থাকেননি। মাত্র ৫০ বছর বয়সে ১৯৩৬ সালে কাজার মারা যান। এমনকি কাজার যখন মারা গিয়েছিলেন তখনও তার সাথে কেউ ছিলনা, তিনি একাই ছিলেন। আর এখান থেকেই বলা যায় কাজারের প্রথম জীবন আনন্দময় এবং সুখের হলেও জীবনের শেষ সময় তার জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলার মতনও কেউ ছিল না।
No comments:
Post a Comment