১২ দিনের মধ্যে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফায় ভারত সফরের পিছনে কী ? - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Friday 21 June 2024

১২ দিনের মধ্যে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফায় ভারত সফরের পিছনে কী ?

 


১২ দিনের মধ্যে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফায় ভারত সফরের পিছনে কী ?



প্রেসকার্ড নিউজ ন্যাশনাল ডেস্ক, ২১ জুন: এটা কোনও রুটিন ব্যাপার নয় যে শেখ হাসিনার মত একজন রাষ্ট্রপ্রধান ১২ দিনের ব্যবধানে দুই বার সরকারী সফরে একটি দেশ সফর করছেন । চলতি মাসে দ্বিতীয় সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার (২১ জুন) নয়াদিল্লিতে আসেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় শপথ অনুষ্ঠানে তিনি ৯ জুন দিল্লী এসেছিলেন।  


হাসিনা শুক্রবার সন্ধ্যায় দিল্লীতে অবতরণ করেন তবে তাঁর প্রধান কূটনৈতিক কার্যক্রম শনিবার অনুষ্ঠিত হবে, যখন তাঁকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হয় এবং নয়াদিল্লীর হায়দ্রাবাদ হাউসে মোদীর সাথে শীর্ষ বৈঠকও করেন। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন।


আগামী মাসে তার বহু প্রতীক্ষিত চীন সফরের আগে হাসিনার ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ঘরে ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করে আসছিল, সেই ঘরেই হাতি হয়ে উঠেছে চীন।



ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীন ফ্যাক্টর :

বাংলাদেশ এবং হাসিনার আওয়ামী লীগের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতিগত নিপীড়ন এবং দমনের মুখে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে দেশটিকে স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করার জন্য ভারত একটি স্বাভাবিক অংশীদার।  


 আওয়ামী লীগ এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উভয়ই চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পক্ষপাতী। যেটি কয়েক দশক ধরে ভারতের সাথে প্রতিকূল সম্পর্ক রয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় পরিচালিত হয়ে বিএনপি চীনের দিকে ঝুঁকেছে এবং আওয়ামী লীগ ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে।  


বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া সরকার চীনের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার পর চীন বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। সরকারের প্রধান হিসাবে হাসিনার দীর্ঘ মেয়াদে সরকারে ২০০৯ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বাংলাদেশ চীনের নেতা শি জিনপিংয়ের উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) তে যোগ দেয়। একই সময়ে মোদী সরকারের তিনটি অবিচ্ছিন্ন মেয়াদে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে শেখ হাসিনা।


ভারতের প্রতিবেশী অঞ্চলে তাঁর প্রভাব বলয় সম্প্রসারণের জন্য চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিংপিন ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ২০১৭ সালে চীন বাংলাদেশকে দুটি মিং ক্যাটাগরির সাবমেরিন সরবরাহ করেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন বাংলাদেশকে ভারত থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সাবমেরিন দিয়েছিল চীন।


ইতিমধ্যে চীন তিস্তা নদীকে প্রশস্ত করার প্রস্তাবও দিয়েছে। নদীটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আজও অমীমাংসিত বিরোধ। সম্প্রতি বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থ যোগান দিচ্ছে চীন। ২০২২ - ২৩ সালে শ্রীলঙ্কার আকস্মিক অর্থনৈতিক পতনের ফলে বাংলাদেশকে চীনের অর্থ নিয়ে সতর্কতার সাথে চলতে হতে দেখা যায়। শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে উদ্ধারের জন্য ভারতের তাৎক্ষণিক সাহায্যও বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত ছিল। তবে দুই দেশের মধ্যে ঠান্ডা বিরোধের দিকটিও ধরা পড়েছে। ক্রিকেট বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া ভারতকে পরাজিত করার সময় বাংলাদেশে উদযাপনের দৃশ্য ভারতীয়দের অনেককে নাড়া দিয়েছিল। এটাও স্বীকার করতে হবে ভারতের কাছে বাংলাদেশ একটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ। পশ্চিমবঙ্গের মত বাংলা সংস্কৃতি ভাগ করে নিয়েছে ।এই মিল দীর্ঘকাল ধরে ভারতের বাকি অংশকে ইতিবাচক উপায়ে প্রভাবিত করেছে।  


তবে ৭ জানুয়ারির বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশ একটি "ইন্ডিয়া আউট" (ভারত বয়কট) প্রচারণা দেখা দিয়েছে। এই নীতিতে মালদ্বীপের নির্বাচনের প্রচারাভিযানে সফল হয়ে মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।


বাংলাদেশের বহু মানুষ শেখ হাসিনাকে "ইন্ডিয়া আউট" প্রচারণার সমর্থকরা ভারতের পুতুল বলে অভিহিত করেছেন।দেশটির নিষিদ্ধ হওয়া ইসলামী দল জামায়াত-ই-ইসলামীর ক্যাডাররা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা পেলেও, বাংলাদেশী জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব জাগানোর জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।  


বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা নতুন কিছু নয় কিন্তু এর আগেও এটা সবসময়ই এর রাজনীতির শেষ প্রান্তে ছিল। ১৯৭১ সালে ভারতীয় বাহিনীর সাহায্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই মেজর এম এ জলিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেন। ১৯৭৫ সালে ভারতপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল।  


এখনও কিছু গোষ্ঠী বাংলাদেশের সরকারী ভাষা বাংলার চেয়ে উর্দু (যা ভারতে উদ্ভূত এবং পাকিস্তানের সরকারী ভাষা) পছন্দ করার প্রস্তাব দিয়ে হাসিনা সরকারকে আক্রমণ করে থাকে। ভারতবিরোধী প্রচারকারীরা বাংলাদেশের প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ভারত সরকারের প্রণীত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) উল্লেখ করেছে।


বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বাভাবিক আগ্রহের মধ্যে হাসিনা অবশ্য এ বছর চতুর্থবারের মত নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ফলাফল প্রভাবিত করার চেষ্টার অভিযোগে ভারত বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করা থেকে দূরে থেকেছিল। কয়েক মাস পরে, প্রথমবারের মতো, হাসিনা এই মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এর আগে হাসিনা এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন।


 অবৈধ অভিবাসন এবং মানব পাচার ইস্যুতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন সবসময়ই একটি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এবং জাতিগতভাবে আবেগপ্রবণ বিষয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের হস্তক্ষেপ ঘটেছিল এবং প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ ভারতে পালিয়ে আসে। তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ থেকে যায়।


 সীমানাবিহীন এবং বেড়াবিহীন সীমান্তের কারণে ভারতে একটি ভাল অর্থনৈতিক পথের সন্ধানে কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ লোকদের ভারতে অনুপ্রবেশ আজও অব্যাহত। রাজনৈতিক ভাবে বহুবার পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব রাজ্যের প্রতিটি নির্বাচনে উঠে এসেছে অবৈধ অভিবাসীদের বসবাস।


বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক অবৈধ অভিবাসী মানব পাচারের মাধ্যমে ভারতে এসেছে তা অস্বীকার করতে পারেনি কেউই । ৪১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের সীমানা নির্ধারণে সম্মত হওয়া এবং বেড়া দেওয়ার কাজ চলমান থাকায় মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কিছু নিষেধাজ্ঞা এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি ভারত-বাংলাদেশ কূটনীতির মাংসের কাঁটা রয়ে গেছে।


বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় অংশ রয়েছে। যারা ২০১৭ সালের পর মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে পাড়ি জমায়। ARSA নামে পরিচিত একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী সামরিক পোস্টে হামলা চালালে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলে যায়।  


বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কয়েক হাজার স্থল ও জলপথে ভারতে পাড়ি জমায়। ভারত বারবার বলেছে যে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উপায় বের করবে। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ আজও হয়নি।  


ভারত মায়ানমারের মধ্যেও সীমানা ভাগ করে। ফলে রিপোর্টে দেখা যায় যে ভারতে রোহিঙ্গাদের অভিবাসন প্রধানত বাংলাদেশ এবং বঙ্গোপসাগরের রুট দিয়ে ঘটেছে বা ঘটছে। নেপাল ও ভুটানের মধ্য দিয়ে অন্যান্য রুট থেকেও রোহিঙ্গারা ভারতে প্রবেশ করেছে। এটা ভারত নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করে।


চলতি বছরের মার্চ মাসে ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টকে নথি দিয়ে বলেছিল, "ভারতে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসন অব্যাহত এবং তাদের ভারতে থাকা সম্পূর্ণ অবৈধ হওয়া । এটা গুরুতর জাতীয় নিরাপত্তার প্রভাব রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি গুরুতর নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে।"


তিস্তা নদীর বিরোধ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও দুই দেশ ২০১১ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের কাছাকাছি এসেছিল কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধীরা সুযোগটি হাতছাড়া হয়েছিল। সেই থেকে তিস্তা চুক্তি ঝুলে আছে।


সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ড্রেজিং কাজ চালিয়ে তিস্তা নদীকে সম্প্রসারণ করার জন্য চীন বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ তিস্তা নদীর জন্য চীনের কাছে ৯৮৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছিল।  


চলতি বছরের মে মাসে ভারত পাল্টা প্রস্তাব দেয়। ভারত বলেছে যে তারা তিস্তা নদীর প্রকল্প অর্থায়নে আগ্রহী। মোদির শপথ অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার পর হাসিনা বাংলাদেশের সংসদে ১৩ জুন বলেছিলেন যে তার সরকার দুটি প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন করবে। মজার বিষয় হল, তিনি আরও বলেছিলেন যে চীনের প্রস্তাবে ভূমি উন্নয়ন এবং জল চলাচলের মতো বিষয়ে স্পষ্টতার অভাব ছিল।


 তিস্তার পাশাপাশি গঙ্গার দিকেও নজর দেওয়া যেতে পারে। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার জল বণ্টন চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হতে চলেছে।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad