নিজস্ব সংবাদদাতা, হাওড়া, ৩০ অক্টোবর: ‘হাজার হাত কালী মন্দির’ রয়েছে হাওড়ার শিবপুর ওলাবিবিতলা এলাকায়। প্রায় ১৫০ বছরেরও প্রাচীন এই মন্দির। মায়ের ভক্তরা ছড়িয়ে আছেন উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারত জুড়ে। এখানে কালী পুজো হয় তন্ত্র মতে। হয় প্রচুর ভক্ত সমাগম। পুরাণ মতে, অসুর নিধনের সময় মা দুর্গা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছিলেন, যার মধ্যে মায়ের এই রূপটিই হাজার হাত কালী নামে পরিচিত। পুজো ঘিরে প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে।
কলকাতার চোরবাগান এলাকার বাসিন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে মা চণ্ডী নাকি স্বপ্নাদেশ দিয়ে কালীর এই রূপ দেখান এবং মন্দির তৈরির আদেশ দেন। সেই স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী, তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবীর এই রূপের পুজো করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। হাওড়ার শিবপুরে প্রথমে হোগলা পাতার ছাউনি, ছিটাবেড়ার দেওয়াল ঘেরা মন্দিরে দর্মায় হাজার হাত এঁকে মায়ের পুজো করা হতো। পাকাপোক্ত ভাবে এই মন্দির নির্মাণের বিপুল ব্যয়ভার বহন করার সাধ্য ছিলনা তাঁর। পরে ১৮৮০ সালে স্থাপিত হয় হাজার হাত কালী মন্দির এবং দেবীর এই বিশেষ রূপ এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সেই থেকে তন্ত্র মতে পূজিত হয়ে আসছেন দেবী।
বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন প্রতিষ্ঠা হয় এই মন্দির। কথিত আছে, সেই সময় আশেপাশের এলাকা জঙ্গলাবৃত্ত থাকায় এই মন্দিরে পুজো দিয়ে যেতেন ডাকাত ও দস্যুরা। এই হাজার হাত কালীর এক অদ্ভুত রূপ। এখানে দেবীর অস্ত্র ও মুকুট তৈরি হয়েছে প্রায় ১২ কেজি রুপো দিয়ে। এছাড়া রুপো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দেবীর মাথার ছাতা। নীলবর্না এই দেবীর বাঁ হাতে খড়্গ, ডান হাতে পঞ্চশূল। বাঁ পা সিংহের উপরে এবং ডান পা পদ্মফুলের উপরে রয়েছে। দুটি পা দু-দিকে থাকার অর্থ, মা যেমন জলেও রয়েছেন, তেমন স্থলেও রয়েছেন। ডান হাতে পঞ্চশূল দিয়ে মা সকলকে যেমন রক্ষা করছেন, তেমনই কেউ যদি ভুল করে বা ভুল পথে যায় তাহলে মা তাকে খড়্গ দেখিয়ে সচেতন করার বার্তাও দিচ্ছেন।
মা কালীর এই রূপ সচরাচর দেখা যায় না। এখানে প্রতিদিন সকাল ৬.৩০, দুপুর ২টো এবং রাত ৮.৩০- এর সময়ে পুজো হয়। দেবীর নৈবেদ্যতে থাকে মাছ, ভাত, ফল-মিষ্টি। রাতের আরতির পর হয় প্রসাদ বিতরণ। এই হাজার হাত কালী মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল, অতীতে বলি প্রথা থাকলেও প্রায় সত্তর বছরের বেশি সময় হল আর কোনও বলিপ্রথা নেই।
কথিত আছে, দক্ষিণ ভারতের এক ভক্ত স্বপ্নের মাধ্যমে এই মন্দিরে মায়ের বিরাজের প্রসঙ্গে জানতে পারেন। তারপর তিনি এটি দর্শনের পর থেকে দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এই মন্দিরের কাহিনী। সেই থেকে মন্দিরে প্রচুর দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তদের যাতায়াত হয়। তাঁরা শ্রাবণ মাসে শুক্লপক্ষের শুক্রবারে দক্ষিণ ভারত থেকে এই মন্দিরে এসে দেবী দর্শনের সাথে-সাথে পুজো দিয়ে থাকেন। প্রায় ২৫ ফুট উঁচু হাজার হাত বিশিষ্ট কালী মূর্তি এবং এই দেবীর নাম থেকেই এলাকার প্রচলিত নাম হাজার হাত কালীতলা।
প্রতিষ্ঠাতা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের সদস্যরাই বংশপরম্পরায় প্রাচীন প্রথা মেনে আজও মন্দিরের সেবায়েতের কাজকর্ম করে আসছেন। মায়ের পুজো ও মঙ্গলারতিতে যাতে কোনও রকম অসুবিধা না হয়, সেজন্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মায়ের মন্দিরের নামে বেশ কিছু সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন। সেই সম্পত্তি থেকে যে আয় হয়, তা থেকে মায়ের পুজো করা হয় ও মন্দিরের সংস্কার করা হয়।
প্রতিষ্ঠা দিবস বুদ্ধপূর্ণিমায় যেমন বেশ জাঁকজমক করে দেবীর পুজো হয়, তেমনই কালীপুজোর দিন তন্ত্র মতে মাকে পুজো করা হয় এখানে। যদিও অতীত থেকেই তন্ত্র মতে পূজিতা হয়ে আসছেন দেবী। এই বছর কালীপুজোতেও জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে হাওড়ার হাজার হাত কালী মন্দিরে।
হাজার হাত কালী মন্দিরের সেবক প্রতাপ মুখোপাধ্যায় জানান, কালী পুজোর দিনে পুণ্যার্থীদের ভিড় এতটাই হয় যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করতে হয়। বিশ্বাস, মায়ের কাছে কিছু প্রার্থনা করলে সেটি পূর্ণ হয়। কালী পুজোর দিন খিচুড়ি, পায়স, পোলাও, মাছ, মিষ্টি সহ একাধিক নানা পদ ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। তিনটি সময় পুজো হয়; ভোরবেলা, দুপুরবেলা ও রাতের বেলা। ফল মিষ্টি দিয়ে পুজো করা হয় মাকে।
No comments:
Post a Comment