রিয়া ঘোষ, ১৩ ফেব্রুয়ারি : ভারতে আমকে 'ফলের রাজা' বলা হয় এবং বিহার আম উৎপাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। আমের ফুল ফোটানো জলবায়ু পরিস্থিতির উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এর তীব্র পরিবর্তন হচ্ছে। তাপমাত্রার অস্থিরতা, আর্দ্রতার পরিবর্তন, হাওয়ার উচ্চ গতি এবং বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা আমের উৎপাদনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এই প্রবন্ধটি বিহারের কৃষি-জলবায়ুর উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্লেষণ করে এবং আমের ফুল ফোটার উপর এর প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধানের উপর আলোকপাত করে।
বিহারের জলবায়ু মূলত গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত, যেখানে গ্রীষ্ম, শরৎ এবং শীতকালে স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আমের ফুল ফোটে মূলত শীতের শেষের দিকে এবং বসন্তের শুরুতে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি), যখন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০-১৫° সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৫-৩০° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে।
বিহারের সমস্তিপুরের পুসার ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ কেন্দ্রীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত জলবায়ু সম্পর্কিত তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফেব্রুয়ারি মাসে তাপমাত্রার অনিয়মিত বৃদ্ধি এবং হ্রাস রেকর্ড করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির আবহাওয়া প্রতিবেদনে এই অস্থিরতা দেখানো হয়েছে...
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৭.০° সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১.৫° সেলসিয়াস, যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল।
১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫: সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে, যা ফুল ফোটার শুরুতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: তাপমাত্রা আবার সর্বোচ্চ ২৭.৬° সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ৯.৬° সেলসিয়াসে উন্নীত হয়, যার ফলে পরিপক্কতা প্রক্রিয়া অস্থির হয়ে পড়ে।
উপরন্তু, আপেক্ষিক আর্দ্রতার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ওঠানামা লক্ষ্য করা গেছে, যা আমের পরাগায়ন এবং ফল ধারণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে।
আমের ফুলের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব আমের ফুল ফোটার প্রক্রিয়ার উপর দেখা যায়। আমের ফুল ফোটার উপর নিম্নলিখিত প্রভাবগুলি দেখা যাচ্ছে:
১. তাপমাত্রার ওঠানামার প্রভাব
আমের ফুল ফোটার জন্য উপযুক্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০-১৫° সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ ২৫-৩০° সেলসিয়াস হওয়া উচিত। যখন তাপমাত্রা এর চেয়ে বেশি বা কম হয়, তখন এর প্রতিকূল প্রভাব পড়ে:
অত্যধিক উচ্চ তাপমাত্রা (২৭-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে) ফুলের প্রাথমিক পরিপক্কতা ঘটায়, যার ফলে ফুলের গুণমান খারাপ হয় এবং অকাল ঝরে পড়ে।
অত্যন্ত কম তাপমাত্রা (১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে) ফুল ফোটার গতি কমিয়ে দেয়, যা ফুলের সংখ্যা এবং গুণমানকে প্রভাবিত করে।
২. আপেক্ষিক আর্দ্রতার প্রভাব
সাধারণত ৬০-৮০% আর্দ্রতা ফুল ফোটার জন্য উপযুক্ত, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সকালের আর্দ্রতা ৯৭-৯৯% এবং বিকেলের আর্দ্রতা ৫০-৫৫% এ নেমে আসছে।
অতিরিক্ত আর্দ্রতা অ্যানথ্রাকনোজ (কোলেটোট্রিচাম গ্লোওস্পোরিওয়েডস) এবং পাউডারি মিলডিউ (ওডিয়াম ম্যাঙ্গিফেরে) এর মতো ছত্রাকজনিত রোগকে উৎসাহিত করে।
কম আর্দ্রতা ফুলের পরাগায়নের হার হ্রাস করে, ফলে ফলের সংখ্যা হ্রাস পায়।
৩. পশ্চিমা হাওয়ার উচ্চ গতির প্রভাব
পশ্চিমা হাওয়ার তীব্র বেগের কারণে ফুল ও ছোট ফলের ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পায়।
তীব্র হাওয়া পরাগরেণু উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে, যা নিষেক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
হাওয়ার গতি কম থাকলে পরাগায়ন বিলম্বিত হতে পারে, ফলে ফল গঠনের সম্ভাবনা কমে যায়।
৪. বৃষ্টিপাতের অভাবের প্রভাব
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে হালকা বৃষ্টিপাত ফুল ফোটাতে সাহায্য করে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই সময়কালে বৃষ্টিপাত কমে গেছে।
মাটিতে আর্দ্রতা কম থাকার কারণে, ফুলগুলি দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং ঝরে পড়তে শুরু করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে ব্যবস্থা
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে যেমন জৈব মালচ (আখের পাতা, শুকনো ঘাস, খড় ইত্যাদি) ব্যবহার করে মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণ করা যায় এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তীব্র হাওয়া থেকে রক্ষা পেতে কাঁঠাল, বাঁশ, নিমের মতো গাছ লাগানো যেতে পারে। বোরন এবং জিঙ্ক স্প্রে করে ফুলের মান উন্নত করা যেতে পারে। আম্রপালি, মল্লিকা, ল্যাংড়া, দশেরির মতো জাতগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি বেশি সহনশীল। ফুল ফোটার সময় রাসায়নিক ওষুধের ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত, যাতে পরাগায়ন প্রভাবিত না হয়।
No comments:
Post a Comment