ন্যাশনাল ডেস্ক, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ২২:৩৮:০০: কাশ্মীরের পহেলগামের বৈসারন উপত্যকায় সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর একদিন পরেই ভারত সরকার অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুধবার অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিএস) বৈঠকে ১৯৬০ সালের সিন্ধু জল চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভারত সিন্ধু এবং এর উপনদীর জলের ওপর নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার সাথে সাথে, যাকে পাকিস্তানের জীবনরেখা বলা হয়, সেখানকার মানুষ জলের জন্য আকুল হবে। সিন্ধু ও এর উপনদী, চারটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ২১ কোটির বেশি জনসংখ্যার জলের চাহিদা মেটানো নির্ভর করছে এসব নদীর ওপর।
সিন্ধু জল চুক্তি কী?
সিন্ধু জল চুক্তি ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের সামরিক জেনারেল আইয়ুব খানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল করাচিতে। ৬০ বছরেরও বেশি সময় আগে স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তির অধীনে, সিন্ধু এবং এর উপনদী থেকে ভারত ১৯.৫ শতাংশ জল পায়। পাকিস্তান প্রায় ৮০ শতাংশ জল পায়। ভারত তার অংশেরও মাত্র ৯০ শতাংশ জল ব্যবহার করে। ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু উপত্যকাকে ৬টি নদীতে বিভক্ত করে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তির আওতায় দুই দেশের মধ্যে প্রতি বছর সিন্ধু জল কমিশনের বৈঠক করা বাধ্যতামূলক।
সিন্ধু জল চুক্তি সংক্রান্ত সর্বশেষ বৈঠকটি ৩০-৩১ মে ২০২২ নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উভয় দেশই এই বৈঠককে সৌহার্দ্যপূর্ণ বলে বর্ণনা করে। পূর্ব নদীগুলোর ওপর ভারতের অধিকার রয়েছে। যেখানে পশ্চিমের নদীগুলো পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি হয়েছিল। তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদী সতলজ, বিয়াস এবং রাভি থেকে বরাদ্দ মোট ১৬৮ মিলিয়ন একর ফুট বার্ষিক জলের মধ্যে ভারতকে ৩৩ মিলিয়ন একর ফুট বার্ষিক জল বরাদ্দ করা হয়েছে।
ভারতের ব্যবহারের পর অবশিষ্ট জল চলে যায় পাকিস্তানে। যেখানে সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের মতো পশ্চিম নদীগুলোর বার্ষিক জলের প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন একর ফুট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পাকিস্তানকে। সিন্ধু জল প্রণালীতে প্রধান নদীর পাশাপাশি পাঁচটি উপনদী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই নদীগুলো হলো রাভি, বিয়াস, সতলজ, ঝিলাম ও চেনাব। এই নদীগুলো সিন্ধু নদীর বাম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। রাভি, বিয়াস ও সতলেজকে পূর্ব নদী বলা হয় এবং চেনাব, ঝিলাম ও সিন্ধুকে পশ্চিম নদী বলা হয়। এই নদীগুলোর জল ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে এই চুক্তি স্থগিত করা পাকিস্তানের জন্য ব্যয়বহুল প্রমাণিত হবে।
প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা-
অনেক বিশেষজ্ঞ সিন্ধু জল চুক্তিকে ঐতিহাসিক ভুল বলে মনে করেছেন। তাঁরা বলে আসছেন, ভারতের উচিৎ এই ভুল সংশোধন করে চুক্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা এবং সিন্ধু ও তার উপনদীর জল যথাযথ পরিমাণে বরাদ্দ করা। পাকিস্তান থেকে থেকেই ভারতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় রক্ত ও জল একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না। দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের আশায় নেহেরু এই চুক্তি করেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিবারই এই আশাকে ধূলিস্যাৎ করেছে। এমতাবস্থায় ভারত সরকারের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য মারাত্মক ও গভীর আঘাত হিসেবে প্রমাণিত হতে চলেছে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর জল নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে ভারত জল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, যাতে পাকিস্তানে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এরপর চুক্তির মাধ্যমে জল সরবরাহ শুরু হয়। এর পরে, ১৯৪৯ সালে, একজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ডেভিড লিলিয়েনথাল রাজনৈতিক স্তর থেকে প্রযুক্তিগত এবং ব্যবসায়িক স্তরে এই সমস্যার সমাধান করার পরামর্শ দেন। লিলিয়েনথাল বিশ্বব্যাংকের সাহায্য চাওয়ার সুপারিশও করেন।
১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বরে, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ইউজিন রবার্ট ব্লেক মধ্যস্থতা করতে সম্মত হন। প্রায় ১০ বছর ধরে বৈঠকের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল এবং কয়েক বছর ধরে আলোচনার পর, ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জল সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়। একেই ১৯৬০ সালের সিন্ধু জল চুক্তি বলা হয়। এই চুক্তিটিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।
চুক্তির শর্তাবলী ১৯৬১ সালের ১২ জানুয়ারী থেকে বাস্তবায়িত হয়। এভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি বড় বিরোধের সমাধান হয়। এই চুক্তির আওতায় ৬টি নদীর জল বণ্টনের সিদ্ধান্ত হয়, যা ভারত থেকে পাকিস্তানে যায়। পূর্বের ৩টি নদী (রাভি, বিয়াস ও সতলেজ)-র জলের ওপর ভারতকে পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়। বাকি ৩টি পশ্চিমের নদীর (ঝিলম, চেনাব, সিন্ধু) জলের প্রবাহ বিনা বাধায় পাকিস্তানকে দিতে হবে। ভারতে পশ্চিমের নদীগুলির জল ব্যবহার করা যেতে পারে।
No comments:
Post a Comment