মুর্শিদাবাদের সহিংসতার ঘটনা পূর্ব-পরিকল্পিত: মমতা; মোদী-ইউনূসের বৈঠক নিয়েও প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রীর - Press Card News

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Wednesday, April 16, 2025

মুর্শিদাবাদের সহিংসতার ঘটনা পূর্ব-পরিকল্পিত: মমতা; মোদী-ইউনূসের বৈঠক নিয়েও প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রীর


কলকাতা, ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৪৭:০০: দেশে নতুন ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় সহিংসতার ঘটনায় প্রাণ গেছে তিনজনের। এছাড়াও পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া, সম্পত্তি ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ, গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। এনিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, 'পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। আমি জনগণের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাচ্ছি।' তাঁর দাবী, 'তৃণমূল কংগ্রেস যদি গন্ডগোল করত, তাহলে তাঁদের দলের তিনজনের বিধায়কের বাড়িতে ভাঙচুর হতো না, দলীয় কার্যালয়ও ভাঙচুর হতো না।'  


বুধবার কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ইমাম, মুয়াজ্জেম ও বুদ্ধিজীবীদের সম্মেলনে উপস্থিত থেকে মমতা কার্যত স্বীকার করে নিয়ে বলেন, 'ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে কিছু অশান্তি হয়েছে, প্ররোচনামূলক কথাবার্তাও হয়েছে। যেখানে গন্ডগোল হয়েছে ওটা মুর্শিদাবাদ জেলা হলেও সেটা মালদহের আসন। ওটা কংগ্রেসের জেতা আসন। জেতবার সময় জিতবে, আর দাঙ্গা হলে রাস্তায় বেরোবে না, নিয়ন্ত্রণ করবে না, এইটুকু আশা আমি করিনি। কংগ্রেসের উচিৎ ছিল পরিস্থিতি শান্ত করা।' 


সংসদে ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাশ, তা আইনে পরিণত করা এবং কার্যকর করার সময়সীমা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রশ্ন 'ওয়াকফ আইন নিয়ে এত তাড়াহুড়ো করার কী দরকার ছিল? আপনারা কী একসাথে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার খেতে পারেন? যদি তাই হত তবে সময়টা কেন ভাগাভাগি করা রয়েছে? আমি উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিতে আসিনি, কারণ আমি শান্তি চাই।' 


এই ইস্যুতে বিমস্টেক সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক নিয়েও খোঁচা দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তিনি বলেন, 'ভারত সরকারকে আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি আপনি কেন এত তাড়াহুড়ো করছেন? আপনি কি বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানেন না? পশ্চিমবঙ্গ হল প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার সীমানা। আপনি মোহাম্মদ ইউনূসের সাথে গোপন বৈঠক করুন, চুক্তি করুন। দেশের ভালো হলে আমি খুশি হব। কিন্তু আপনার পরিকল্পনা কি? আপনাদের পরিকল্পনাটা কি? কোনও এজেন্সির মাধ্যমে ওখান থেকে লোক নিয়ে এসে এখানে দাঙ্গা করা?' 


ইতিমধ্যেই ওই সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশি যোগ উঠে এসেছে। প্রাথমিক তদন্তে এমনটাই দাবী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও এই তথ্য উঠে এসেছে। তা নিয়ে একযোগে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ'এর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, 'গতকাল আমি একটি সংবাদমাধ্যমে ট্যুইট দেখলাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে 'মুর্শিদাবাদের সহিংতার পিছনে বাংলাদেশের হাত রয়েছে। যদি তাইই হয় তাহলে তার দায় তো কেন্দ্রীয় সরকারের। কারণ সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব বিএসএফের। আমরা সীমান্ত রক্ষা করি না। রাজ্য সরকারের হাতে সেই অধিকার নেই। আপনারা কেন অনুমতি দিয়েছেন? আপনারা কেন বাইরে থেকে লোক এনে গন্ডগোল পাকিয়ে চলে গেছেন? এর উত্তর দিতে হবে।' 


মমতার বক্তব্য, যদি সত্যিই বাংলাদেশের লোক ঢোকানো হয় থেকে থাকে, তবে আপনি কেন ঢুকতে দিলেন? বিএসএফ কেন ঢুকতে দিয়েছিল? বিএসএফ তাদের কেন প্রবেশের অনুমতি দিল? সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব আমাদের হাতে নেই। প্লেন চলছে, প্লেনে কারা আসছে, কীভাবে আসছে... আগে এয়ারপোর্টে আমাদের পুলিশ থাকতো, আমরা রিপোর্ট পেতাম। এখন সেটা উঠিয়ে দিয়েছে। তাই কোনও রিপোর্ট পাইনা। আপনারা কি মনে করেন যে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলা খেলবেন। পর্দার পিছনে কি আছে, আমরা সব বুঝতে পারি।' 


এমনকি বিএসএফ বাচ্চাদের দিয়ে পাথর ছুড়িয়েছে বলেও মারাত্মক অভিযোগ এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, 'আমি খুঁজে বের করব সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ কাকে কাকে হাত করেছে। কিছু বাচ্চা ছেলেকে ৫/৬ হাজার টাকার বিনিময়ে পাথর ছুঁড়িয়েছে। এটা ভালো করে তদন্ত করব, আমাদের তদন্ত চলছে।' 


মোদীর মুসলিম দেশ সফর ও সেই দেশের নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। তাঁর কটাক্ষ 'আপনি আরব আমিরাতে গেলে কার সাথে দেখা করেন? মুসলিমদের সাথে দেখা করেন না? আপনি যখন সৌদি আরবে যান তখন কার সাথে গলা মেলান? দুবাইয়ে গেলে কার আতিথেয়তা গ্রহণ করেন? দেশে এক কথা বলেন আর বাইরে গিয়ে আরেক কথা বলেন! এই দ্বিচারিতা চলবে না। আপনার তো লজ্জা হওয়া উচিৎ। নির্বাচনের সময় আপনি বলেন, আমরা সকলের সাথে, সকলের পাশে। আর ভোট হয়ে গেলেই আপনাদের নেতারা বলেন যারা ভোট দেবে, আমরা তাদের পাশে রয়েছি।' 


তাঁর অভিমত 'উনি (প্রধানমন্ত্রী) যদি সৌদি আরবে গিয়ে গলা মেলান তাতে কোন দোষ নেই। নরেন্দ্র মোদী কেন নরেন্দ্র ইসলাম হবে না? আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গেলেই তাঁর পদবী বদলে দেওয়া হয়।' 


কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নাম্বার-২ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ'কেও নিশানা করেছেন মমতা। তৃণমূল নেত্রী বলেন, 'উনি যদি কালিদাসের মতো যে ডালে বসে আছে সেই ডালই কাটে তাহলে তো কিছু বলতে হবেই। আপনার এত তাড়াহুড়ার কি ছিল? আপনি তো কোনদিন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী চলে গেলে আপনি কি করবেন? আপনাকে হামাগুড়ি দিতে হবে। আপনিই সবচেয়ে বেশি দেশের ক্ষতি করেছেন। আমি মোদীজিকে অনুরোধ করব, দয়া করে ওই লোকটাকে কন্ট্রোল করুন। উনার হাতে সমস্ত এজেন্সির দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর উনিই সমস্ত পরিকল্পনা করছেন।' 


বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের জোট শরিক টিডিপি এবং জেডিইউ'কেও নিশানা করেছেন মমতা। তাঁর প্রশ্ন 'কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের কি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে? আর দেখুন চন্দ্রবাবু নাইডু চুপচাপ বসে আছেন। নীতীশ কুমার চুপচাপ বসে আছেন। ক্ষমতার লোভে এরা চুপচাপ বসে আছেন। এই ইস্যুতে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতার লোভে এরা নিজের রক্ত দিয়ে দিতে পারেন।' 


বিতর্কিত এই ওয়াকফ আইন যে তিনি কোনও ভাবেই মেনে নেবেন না সেকথাও এদিন ফের একবার স্পষ্ট করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রশ্ন, 'আপনাদের যদি ওয়াকফ আইনের পরিবর্তন করার দরকার হয়, তবে সংবিধান কেন সংশোধন করেননি? সংবিধান সংশোধন করতে গেলে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার। কিন্তু আপনারা সেটা না করে বিল নিয়ে আসলেন। আমরা এটা সমর্থন করিনি, করবও না।' 


মমতার মতে, এই আইনের মধ্যে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাই এই আইন 'অ্যান্টি ফেডারেল স্ট্রাকচার।' বিরোধী 'ইন্ডিয়া' জোটের প্রতি মমতার আহ্বান 'আপনারা একসাথে এর বিরুদ্ধে লড়াই করুন। এটা ব্যক্তিগত বিষয় নয়। আজকে আপনাদের বিরুদ্ধে করছে, কালকে আরেকজনের বিরুদ্ধে করবে।' 


এসময় মমতার ভবিষ্যদ্বাণী, 'আগামী একটা বছর ধৈর্য ধরতে হবে। এরপর দিল্লীতে অনেক পরিবর্তন হবে। সেদিনটার জন্য অপেক্ষা করব। আবার নতুন সরকার হবে। দরকার হলে যেদিন বিজেপি ক্ষমতা থেকে চলে যাবে- সংবিধান সংশোধন করে জনবিরোধী আইনগুলিকে বদলাতে হবে।' 


পশ্চিমবঙ্গের এই আন্দোলন দিল্লিতে ছড়িয়ে দেওয়ার বার্তা দিয়ে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে মমতা বলেন, 'বাংলায় আন্দোলন করে লাভ নেই। আন্দোলনটা দিল্লীতে গিয়ে করুন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চান, রাষ্ট্রপতির কাছে সময় চান। দিল্লীতে কর্মসূচি গ্রহণ করুন। প্রয়োজন হলে সকলকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করুন। আমি কথা দিচ্ছি তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরা আপনাদের সাথে থাকবে। বিরোধী 'ইন্ডিয়া' জোটের সব রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ জানাবো তারাও আপনাদের সাথে থাকবেন। গণতান্ত্রিক কায়দায় আন্দোলন করুক। কিন্তু এর মধ্যে যদি কেউ প্ররোচনা দেয়, দাঙ্গায় উস্কানি দেয়- সে যেই হোক না কেন আমার কাছে ক্ষমা পাবে না।' 

 

বিজেপির প্ররোচনায় পা না দেওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি এলাকায় শান্তি রক্ষায় ইমাম মোয়াজ্জেমদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মমতা। তাঁর আহ্বান, 'আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা এলাকায় শান্তি রক্ষা করুন। বিজেপির লক্ষ্যই অশান্তি পাকানো। রামনবমীর দিন এই পরিকল্পনা ছিল সেই পরিকল্পনা আপনারা ভেস্তে দিয়েছেন। বিজেপির কথায় পা দিয়ে অশান্তি করার চেষ্টা করলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করুন। আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন, ভরসা রাখুন- বিভাজন হতে দেব না। আমরা কখনও হিন্দু-মুসলিম ভাগাভাগি করি না। বাংলায় শান্তি থাকলে আমরা শান্তিতে থাকতে পারব।' 


সকল ধর্মের মানুষকে পাশে নিয়ে তৃণমূল নেত্রীর বার্তা- 'আমরা কেউ একা নই। আমার একটা আঙুল যদি হিন্দু হয়, আর একটা আঙ্গুল মুসলমান, আরেকটা আঙ্গুল শিখ, আরেকটা জৈন।' 


সবশেষে ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে মুর্শিদাবাদ জেলায় সহিংসতায় নিহত তিন জনের পরিবারকে রাজ্য সরকারের তরফে ১০ লাখ করে আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করার পাশাপাশি যাদের বাড়ি ভেঙেছে- তাদের বাংলার বাড়ি প্রকল্পের অধীন বাড়ি করে দেওয়া, যাদের সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে- মুখ্যসচিব তাদের সেই ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করে তাঁদের সেই ক্ষতিপূরণ তুলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad